লস্কর-ই-তইবা-র প্রধান হাফিজ মহম্মদ সইদের মাথার দাম এক কোটি মার্কিন ডলার ধার্য করিয়া ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে এই বার্তা দিয়াছে যে, গাছের খাইয়া তলারও কুড়াইবার দিন গিয়াছে। লস্করের সংগঠক হিসাবে হাফিজ সইদ ভারতের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক সন্ত্রাসবাদী হামলার নীল-নক্শা রচনা করিয়াছেন। ২০০৮ সালে মুম্বই হামলা (যাহাতে ছয় মার্কিন নাগরিক সহ মোট ১৬৬ জন নিহত হন) যে তাঁহারই মস্তিষ্কপ্রসূত, হামলার পরিকল্পনা, জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র, বিস্ফোরক, তহবিল ও রসদের বন্দোবস্তও যে তাঁহারই, সেই মর্মে ভারত পাকিস্তানকে বহু সাক্ষ্যপ্রমাণ সংবলিত নথি দিয়াছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এবং সুপ্রিম কোর্ট সইদের বিরুদ্ধে শাস্তিযোগ্য কোনও অপরাধের প্রমাণ পায় নাই। ফলে কিছু কাল স্বগৃহে অন্তরিন থাকার পর সইদ বহাল তবিয়তে এবং প্রকাশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে তাঁহার পরবর্তী হামলার ছক কষিয়া গিয়াছেন। সেই সইদকে মার্কিন প্রশাসনের দুর্বৃত্ত-তালিকার শীর্ষে তালিবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর এবং আল-কায়দা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি-র সহিত একাসনে বসাইয়া ওয়াশিংটন যে বার্তা দিল, তাহা দ্ব্যর্থহীন।
বার্তাটি হইল, পাকিস্তান আর সন্ত্রাসবিরোধী আন্তর্জাতিক অভিযানে আমেরিকার বিশ্বস্ত সহযোগী নয়, বরং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সূতিকাগার। সন্ত্রাসের আঁতুড় হিসাবে পাকিস্তানের ভূমিকা সম্পর্কে ভারতের অভিযোগের সারবত্তা এখন প্রতিষ্ঠিত। পশ্চিমের মতো ভারতও যে সন্ত্রাসবাদের শিকার এবং সেই সন্ত্রাসীরা যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আশ্রয়, প্রশ্রয়, তহবিল ও রসদেই লালিত, মার্কিন প্রশাসন সহ পশ্চিমী গণতান্ত্রিক দেশগুলি দীর্ঘ কাল তাহা মানিতে চাহে নাই। কিন্তু বিন লাদেনের নিরাপদ আত্মগোপনের আখ্যান উন্মোচিত হইতেই পাকিস্তান সম্পর্কে পশ্চিমের পক্ষপাতদুষ্ট ধারণা সংশোধিত হইতেছে। হাফিজ মহম্মদ সইদ ও তাঁহার লস্কর-ই-তইবার বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির অভিযোগে এত কাল কর্ণপাত না করিলেও এ বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাক-আশ্রিত জঙ্গি নায়ক ও তাহার সংগঠনের কুকর্ম বিষয়ে ওয়াকিবহাল। মার্কিন প্রশাসন স্পষ্টই জানাইয়াছে, মুম্বই হামলার কারণেই সইদকে দুর্বৃত্ত তালিকার শীর্ষে স্থান দেওয়া। অতঃপর সন্ত্রাস দমনে বিপুল মার্কিন অর্থ ও অস্ত্রসাহায্যপুষ্ট পাকিস্তানের পক্ষে সইদকে ‘জনতার স্বেচ্ছাসেবক’ রূপে প্রচার করা কঠিন হইবে।
সইদকে লইয়া ইসলামাবাদের অস্বস্তির আরও কারণ আছে। সম্প্রতি ন্যাটোর বিমান-হানায় দুই ডজন পাক সৈন্যের মৃত্যুর প্রতিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেশময় যে দেশাত্মবোধক ও ইসলামি আত্মমর্যাদার জিগির উস্কাইয়া তোলা হইতেছে, সইদ তাহার অন্যতম প্রধান হোতা। পাক মন্ত্রী, সেনাধ্যক্ষদের উপস্থিতিতে মঞ্চ হইতে তিনি একই সঙ্গে ভারত ও মার্কিন-বিরোধী জেহাদের ডাক দিতেছেন। এখন তাঁহাকে দুর্বৃত্ত-চূড়ামণি রূপে চিহ্নিত করিয়া দেওয়ায় অন্তত প্রকাশ্য জনস্থানে তাঁহার হাত ধরিয়া পাক শাসকদের পক্ষে সংহতিজ্ঞাপক সহাবস্থানের অর্থ হইবে সরাসরি মার্কিন অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ জানানো। কাজটা একটু ঝুঁকির হইয়া যাইবে। বিলম্বে হইলেও এই ঘোষিত মার্কিন অবস্থান ভারতকে কূটনৈতিক ভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় টানিয়া আনিল। এই প্রেক্ষিতেই পাক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির সংক্ষিপ্ত ভারত সফরকে বিচার করিতে হইবে। জারদারির সফর রাজনৈতিক নয়, তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইবে। সেখানে অন্যান্য বিষয়ের সহিত লস্কর-ই-তইবা ও হাফিজ সইদের জেহাদি জঙ্গিপনা নিয়ন্ত্রণ করার প্রসঙ্গটি সঙ্গত ভাবেই উঠিতে পারে। |