বয়স তখন সতেরো। তিনি ছিলেন নাৎসি বাহিনী ‘ভ্যাফেন-এসএস’-এর অন্যতম সদস্য। নোবেলজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস এই তথ্যটা ফাঁস করে দেন বছর ছয়েক আগে তাঁরই আত্মজীবনীতে। সমালোচনার ঝড় ওঠে প্রবল। অনেকে বলেছিলেন, এর পরে গ্রাসকে আর ‘নীতিপরায়ণ’ বলা যায় না।
এই ২০১২-এ আবার ঝড় তুলেছেন তিনি। অশীতিপর সাহিত্যিকের উপরে ফের খাপ্পা তাঁর দেশবাসীদেরই একাংশ। উপলক্ষ, তাঁর একটি কবিতা। যে কবিতায় ইজরায়েলের ইরান-নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। সম্প্রতি ইজরায়েলকে পরমাণু-অস্ত্র বহনকারী একটি সাবমেরিন বিক্রিরও পরিকল্পনা করেছে জার্মানি। গ্রাস তার বিরুদ্ধেও সরব।
বঙ্গানুবাদে কবিতার নাম ‘যা বলা দরকার’। গ্রাস লিখেছেন, “বিশ্বশান্তি এমনিতেই দুর্বল। তাতে আশঙ্কার ছায়া ফেলছে পরমাণু শক্তিধর ইজরায়েল। এটুকু বলার জন্য কলমের কালির শেষ বিন্দুটুকু নিয়ে কেন অপেক্ষা করলাম এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত?” ‘শান্তি’র একটা পথও বাতলে দিয়েছেন গ্রাস। কবিতায় তাঁর প্রস্তাব, “দু’দেশের সরকারের কাছেই গ্রহণযোগ্য কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে তাদের পরমাণু কর্মসূচির একটা পাকাপাকি নজরদারির ব্যবস্থা করা হোক।” |
জার্মান দৈনিক ‘জুডডয়েচে ৎজসাইটুং’-সহ ইউরোপের বেশ কয়েকটা কাগজে বুধবার কবিতাটি প্রকাশিত হতেই শোরগোল পড়ে সর্বত্র। বার্লিনের ইজরায়েলি দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়, “ইহুদিদের দোষারোপ করা ইউরোপীয় ঐতিহ্য। ইজরায়েল একমাত্র দেশ, জন্মলগ্ন থেকেই যার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আমরা প্রতিবেশীদের নিয়ে শান্তিতে থাকতে চাই। গুন্টার গ্রাস আমাদের যে ভূমিকায় দেখতে চাইছেন, তা আমরা গ্রহণ করতে নারাজ।” এমনকী জার্মানিতে ইহুদিদের কেন্দ্রীয় সংগঠনও গ্রাসের কবিতাকে বলেছে, ‘বিরোধের আক্রমণাত্মক ইস্তেহার’।
“রাজনীতি নিয়ে বলতে গিয়ে উনি প্রায়ই ভুল করে বসেন,” গ্রাসের সাহিত্যিক সত্তাকে কুর্নিশ জানিয়েও এই মন্তব্য করেছেন জার্মান পার্লামেন্টের বিদেশ সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান রুপ্রেখট পোলেন্জ। তাঁর, তথা জার্মান চ্যান্সেলার আঙ্গেলা মের্কেলের দল ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন’-এর অন্যতম নেতা ফিলিপ মিসফেল্ডারেরও মন্তব্য, “পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞতার নিদর্শন এই কবিতা।”
সব চেয়ে চাঁচাছোলা আক্রমণটা করেছেন জার্মান দৈনিক ‘ডি ভেল্ট’-এর সাংবাদিক হেনরিক ব্রডার। জার্মানির খ্যাতনামা ইহুদি লেখকদের অন্যতম ব্রডারের কথায়, “ইহুদিদের নিয়ে গ্রাসের বরাবরই সমস্যা ছিল, কিন্তু সেটা তিনি এই কবিতায় যতটা স্পষ্ট করে বলেছেন, আগে তেমন বলেননি। ক্ষমতা দখলের প্রবণতা তাঁর ছিলই, এখন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন। লজ্জা, অপরাধবোধ আর ইতিহাস মুছে ফেলার তাড়নায় তিনি এটা করছেন।”
এমন নয় যে, এই প্রথম ইজরায়েলকে বিঁধলেন গ্রাস। ২০০১-এও এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “ইজরায়েল যে ভাবে প্যালেস্তাইনের জমি দখল করেছে, তা রীতিমতো অপরাধ। ইজরায়েলের উচিত ওই সব এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া।” সেই প্রসঙ্গ তুলেও ব্রডার লিখেছেন, “ওই দাবি তো ইজরায়েলকে তেল আভিভ ছেড়ে দিতে বলার সমান! হামাস বা হিজবুল্লা জঙ্গিরা এমন করে।”
একটি জার্মান লেখক সংগঠনের প্রধান জোহানো স্ট্রাসার অবশ্য গুন্টার গ্রাসের সুরেই ইজরায়েলকে জার্মান সমরাস্ত্র দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। কিন্তু প্রবল সমালোচনার ঢেউয়ে কার্যত ঢাকা পড়েছে সেই ‘সমর্থন’।
ফলে, ৮৪ বছরের নোবেলজয়ী দাঁড়িয়ে ‘গোলাবর্ষণের’ মুখে। কার্যত একা! |