এক লহমা থমকালেন তিনি।
বুলেটপ্রুফ গাড়ি থেকে সবে নেমেছেন। তাঁকে ঘিরে সাদা পোশাকের নিরাপত্তারক্ষীদের বলয়। ফুসফুসে সংক্রমণ জনিত অসুস্থতার জন্য এখন আর সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠেন না তিনি। তবে নামেন সিঁড়ি বেয়ে। পরনের পাঞ্জাবিটা ঠিক করতে করতে বাড়ির পিছনে লিফ্টের দিকে এগোচ্ছেন সবে। কানে গেল
বুদ্ধবাবু!
থমকে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকালেন তিনি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।
এক মিনিট কথা বলা যাবে?
“নাহ্!”
দ্রুত মুখ ঘোরালেন তিনি। ‘সঙ্কেত’ পেয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও কিছু আঁটোসাঁটো হল (বরাবরই অবশ্য তিনি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখেন। মঙ্গলবারই এক সর্বভারতীয় নিউজ চ্যানেলের সাক্ষাৎকারের আর্জি ফিরিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রাক্তনের বিস্তর অমিলের মধ্যে যা অন্যতম)। আবার চলা শুরু করা মাত্র বলা গেল, “কেমন আছেন, জিজ্ঞাসা করতে পারি?”
“পারেন! ভাল আছি।” |
আর কোনও শব্দব্যয় নেই। মুখ ঘুরিয়ে চিলতে গলি দিয়ে লিফ্টের দিকে চলে গেলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। নিজের ঘরে বন্ধ দরজার অন্তরালে তিনি কাটাবেন সন্ধের কিছু পর পর্যন্ত। যেমন কাটান প্রতিদিন। যেমন এসেছিলেন বুধবার সকালে। যেমন পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নেওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন বেলা দেড়টার কিছু আগে। যেমন বেরোন প্রতিদিন। আবার ফেরেন বিকেল পাঁচটার আশেপাশে। নিয়মের (তাঁর দলীয় সতীর্থরা বলেন, ‘কমিউনিস্ট অনুশাসনে’র) কোনও ব্যত্যয় নেই। কলকাতার বাইরে বা উপকণ্ঠে কোনও কর্মসূচি না-থাকলে প্রতিদিন সকাল-বিকেলে আসবেনই তিনি। রবিবার হলেও। কেরলের কোঝিকোড়ে দলের পার্টি কংগ্রেস চললেও।
তফাত অন্যান্য সময় দলের কোনও না কোনও নেতা, হয় রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু অথবা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর কোনও সদস্য বা নিদেনপক্ষে অফিস সম্পাদক সুখেন্দু পাণিগ্রাহীর সঙ্গে খানিক আলাপ-আলোচনা হয় তাঁর। খবরের কাগজ, চা এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎপ্রার্থীর সঙ্গে দেখা করার ফাঁকে ফাঁকে। কিন্তু এখন গোটা আলিমুদ্দিনে কতিপয় টেলিফোন অপারেটর, দলীয় প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত কিছু কর্মী এবং ছুটকো কাজের লোকজন ছাড়া তিনি একেবারে একা! বাকি সকলে কোঝিকোড়ে।
সুযোগ দিলে প্রশ্ন করার ইচ্ছে ছিল, পার্টি কংগ্রেস ‘মিস’ করছেন কি না। করলেও, কতটা ‘মিস’ করছেন। এটা জানেন কি না যে, বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চে তাঁর চেয়ারটা ফাঁকাই রেখে দেওয়া হয়েছিল। জানেন কি না যে, ফাঁকা চেয়ারে অনুপস্থিত থেকেও পার্টি কংগ্রেসের প্রথম দিনের আলোচনায় তিনি ভীষণ ভাবে উপস্থিত! স্বাভাবিক। পার্টি কংগ্রেসের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যে পশ্চিমবঙ্গ, সেখানে তো তিনিই ‘দলের মুখ’। এখনও।
নইলে ফাঁকা আলিমুদ্দিনে তিনি আসার মিনিটদশেক আগে থেকে নড়াচড়া শুরু করে স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ? উটকো যানবাহন সরিয়ে রাস্তা সাফ রাখে? আবার ভরা পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চে খালি থেকে যায় তাঁর জন্য নির্দিষ্ট চেয়ার?
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে দুই সারিতে ১৬টি চেয়ার সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য ও অতিথিদের জন্য। কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডানপাশের দ্বিতীয় সারির কোণের চেয়ারটা ফাঁকাই থেকে গেল।
হিসেব মতো ১৬টি চেয়ারই মঞ্চে থাকার কথা। ভি এস অচ্যুতানন্দন
পলিটব্যুরো থেকে বরখাস্ত। এম কে পান্ধে প্রয়াত। পলিটব্যুরোর সদস্য সংখ্যা তাই ১৫ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৩-য়। কিন্তু পলিটব্যুরো থেকে বরখাস্ত হলেও ভি এস-কে পার্টি কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চের নীচে রাখা সম্ভব হয়নি। ‘বিশেষ অতিথি’র চেয়ারে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রবীণতম সদস্য আর উমানাথ এবং সিপিআই নেতা এ বি বর্ধন। নেই শুধু তিনি। যেমন থাকেন না কলকাতার বাইরে পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে। দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও। |
পার্টি কংগ্রেস শুরুর আগে মঙ্গলবার বিকেলে কোঝিকোড়ে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির আনুষ্ঠানিক বৈঠক বসেছিল। ঘণ্টাখানেকের সেই বৈঠকেও দক্ষিণের ‘কারাট-ঘনিষ্ঠ’ নেতাদের তরফে প্রশ্ন উঠল, বুদ্ধবাবু যখন পার্টি কংগ্রেসেও আসছেন না, কলকাতা ছাড়া অন্যত্র পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে গরহাজির থাকছেন, তখন তাঁকে কেন আর শীর্ষকমিটিতে রাখা হবে?
রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু বলেছেন, “বুদ্ধদেব যে শারীরিক অসুস্থতার জন্য কোঝিকোড়ে এলেন না, তা তিনি চিঠি লিখে জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলিল পেশের পর সাধারণ সম্পাদক চিঠি পড়ে সকলকে শুনিয়েছেন। উনি পার্টি কংগ্রেসের সাফল্য কামনা করেছেন।” সাধারণ সম্পাদক কারাটের কাছে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যে চিঠি ফ্যাক্স করেছেন, তাতে তিনি আরও বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যে আলোচনা হবে, সে বিষয়ে তিনি ‘অবহিত’। পার্টি কংগ্রেসে রাজ্যের সম্পর্কে যে প্রস্তাব নেওয়া হবে, তার প্রতি তাঁর ‘সম্পূর্ণ আস্থা’ থাকবে।
কিন্তু বুদ্ধবাবুর চিঠি তাঁর দলীয় সতীর্থদের একাংশের ‘আস্থা’ অর্জন করতে পারছে না যে! কলকাতার কাগজের সাংবাদিককে পঞ্জাবের সিপিএম নেতা যেমন বলছেন, “বুদ্ধদেব আভি তক উদাস হ্যায় কেয়া?” তার পর স্বগতোক্তি করছেন, “ইতনা দিন তো উদাস নেহি হোনা চাহিয়ে! কমিউনিস্ট হ্যায় তো ফাইট ব্যাক করনা হ্যায়।” অবস্থা বুঝে ঈষৎ ‘বিড়ম্বিত’ বিমানবাবু পাল্টা প্রশ্ন করছেন, “বুদ্ধদেবকে নিয়ে সকলে আলোচনা করছে। রাজ্যের আরও তিন প্রতিনিধি অসুস্থতার জন্য আসতে পারেননি। তাঁদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না কেন?”
বলছেন বটে। কিন্তু বুদ্ধবাবুর পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা তিনি ধামাচাপা দিতে পারছেন না। তিনিও বুঝছেন, অধিবেশনের শেষ দিন নতুুন পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার সময় এই ‘বিতর্ক’ উঠবেই। বুদ্ধবাবু আগেই জানিয়েছেন, আর দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটিতে থাকতে চান না। পরিস্থিতি সাপেক্ষে অন্য রাজ্যের অনেকে তাঁকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়ার পক্ষে। সমর্থন আছে আলিমুদ্দিনের কিছু নেতারও। কিন্তু সীতারাম ইয়েচুরি-সহ কিছু নেতা চান, থেকে যান বুদ্ধবাবু। প্রস্তাব এসেছে, তাঁকে বরং পলিটব্যুরোয় ‘স্থায়ী আমন্ত্রিত’ সদস্য হিসেবে রাখা হোক। অতীতে জ্যোতিবাবুকে যেমন রাখা হয়েছিল। কিন্তু দলের একাংশ জ্যোতি-বুদ্ধকে ‘সমমর্যাদা’ দিতে রাজি নন। তাঁদের যুক্তি, জ্যোতিবাবুু ছিলেন দলের ‘নবরত্নে’র এক রত্ন। বুদ্ধ তা নন। অসুস্থতার জন্য কাউকে কাউকে পলিটব্যুরো থেকে বাদ দেওয়ারও উদাহরণও রয়েছে। কোঝিকোড়ে যিনি পার্টি কংগ্রেসের শুরুতে দলীয় পতাকা তুললেন, সেই উমানাথকেই বয়সজনিত অসুস্থতার কারণে পলিটব্যুরো থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অনেকে চান ‘অসুস্থ’ বুদ্ধবাবুর বদলে এই সঙ্কটসময়ে বিরোধী দলনেতার ভূমিকায় ‘সফল’ সূর্যকান্ত মিশ্রকে পলিটব্যুরোয় নিয়ে আসা হোক।
খাঁ-খাঁ আলিমুদ্দিন। মাসখানেক আগে বাইরের দেওয়ালের কলি ফেরানো হয়েছে। পার্টি কংগ্রেসের জন্য ফটকে-ছাদে লাগানো হয়েছে ঝকঝকে লালঝান্ডা। লাল আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে রাজ্য দফতর। ভিতরে বন্ধ দরজার আড়ালে সময় কাটাচ্ছেন এক পক্ককেশ প্রৌঢ়।
একা। উদাস। কুম্ভ। |