মনমোহন-জারদারির মধ্যাহ্নভোজে হাফিজ সইদের প্রসঙ্গ তোলার জন্য প্রবল দাবি জানাচ্ছে বিজেপি। কিন্তু ৮ এপ্রিল কৌশলগত কারণেই জারদারির কাছে বিষয়টি উত্থাপন না করার সিদ্ধান্ত আপাতত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
কেন এই সিদ্ধান্ত? মনমোহন আজ বলেছেন, “দেশের মধ্যে যারা সন্ত্রাস চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে হবে।” কিন্তু হাফিজ প্রসঙ্গ তোলার বিষয়ে তিনি নিরুত্তর থেকেছেন। আমেরিকা মুম্বই বিস্ফোরণে লস্কর ই তইবা তথা জামাত উদ দাওয়া প্রধান হাফিজের ভূমিকা প্রকাশ্যে নিয়ে আসায় এবং তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করায় কূটনৈতিক মহলে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। এমনকী ওসামা-হাফিজের যোগসাজশেরও বিস্তারিত তথ্য মার্কিন কর্তারা বিদেশ সচিব রঞ্জন মাথাইকে দিয়েছেন। আপাত ভাবে সকলেরই মনে হচ্ছে, আমেরিকার এই পদক্ষেপে পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়াতে ভারতের সুবিধা হবে।
কিন্তু বাস্তবে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক ভিন্ন পথ ধরে এগোচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সূত্র বলছে, জারদারির সফরে যদি মনমোহন সিংহ বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট লস্কর প্রধানের বিরুদ্ধে মুম্বই সন্ত্রাসে জড়িত থাকার অভিযোগ নস্যাৎ করেন, তা হলে কূটনৈতিক ভাবে ভারতের লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হবে। পাকিস্তানের তরফে আজ বলেই দেওয়া হয়েছে, হাফিজের বিরুদ্ধে আইনি পথে এগোতে হলে নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ চাই। |
জারদারির সফর কিন্তু সরকারি সফর নয়। ফলে এই সফরের উদ্দেশ্য আনুষ্ঠানিক ভাবে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু করা নয়। ক’দিন আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রেজা গিলানির সঙ্গে মনমোহনের এক দফা আলোচনা হয়েছে। সেখানেও দু’পক্ষই বরফ গলাতে সচেষ্ট ছিলেন। এমনকী অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হলে প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান সফরে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন। এখন জারদারির সফর মূলত তাঁর নিজস্ব উৎসাহেই হচ্ছে। সাউথ ব্লকের এক কর্তা বলেন, “জারদারির প্রস্তাব আমরা লুফে নিয়েছি। কারণ বিরাট কিছু না হোক, আমাদের লক্ষ্য যতটা সম্ভব এই সফরকে দু’দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপনে কাজে লাগানো।” সে ক্ষেত্রে হাফিজকে নিয়ে তিক্ততা তৈরি হলে কূটনৈতিক উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে না।
পাকিস্তানের টালমাটাল পরিস্থিতিতে জারদারিকে বিপাকে ফেলতেও চান না মনমোহন। ’৭২ সালে সিমলায় এসেছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। তারপর তাঁর জামাতা তথা আর এক গণতান্ত্রিক নেতা এই প্রথম ভারত সফরে আসছেন। পাক প্রশাসন সূত্র বলছে, জারদারির ভারত সফরের পরিকল্পনার নেপথ্যে তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। পাক রাজনীতিতে তাঁর পরিসরকে অক্ষত রাখা ভোটের আগে জারদারির বিরাট লক্ষ্য। পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো জারদারির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভারত-প্রেমের অভিযোগ এনেছে। তা সত্ত্বেও পাক সরকার কাশ্মীর থেকে বাণিজ্য বিস্তার সব ব্যাপারেই কথা বলতে রাজি হয়েছে। ২০০৯ সালের জুন মাসে মনমোহনের সঙ্গে জারদারির শেষ বৈঠক হয়েছিল রাশিয়ায়। সেখানেও দু’জনের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়।
এই পরিস্থিতিতে জারদারিকে ঘরোয়া রাজনীতিতে সমস্যায় ফেলা মনমোহনের উদ্দেশ্য নয়। পাকিস্তানের ভিতরে রয়েছে অনেকগুলো ‘পাকিস্তান’ তথা ক্ষমতার অনেকগুলো কেন্দ্র। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে সেনাবাহিনীর পাকিস্তান, আইএসআইয়ের পাকিস্তান, মোল্লাতন্ত্রের পাকিস্তান, আল কায়দার পাকিস্তান। জারদারির সঙ্গে পাক সেনার সম্পর্ক অহি-নকুল। তবে আমেরিকার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাল। ইসলামাবাদে ফিরে গিয়ে জারদারি কট্টরবাদীদের তোপের মুখে পড়লে আখেরে ভারতের কোনও লাভ নেই। তাই আমেরিকার মন্তব্যে অতি উৎসাহী হয়ে হাফিজের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার জন্য তাল ঠুকবেন না মনমোহন।
হাফিজ অবশ্য আজ আমেরিকার বিরুদ্ধে ফের তোপ দেগেছেন পাকিস্তানে বসেই। রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক করে তিনি বলেছেন, “আমি কোনও গুহায় বা পাহাড়ে লুকিয়ে নেই। রাওয়ালপিন্ডিতে আছি। কাল লাহৌরে থাকব। আমেরিকা যেখানে চায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুক আর পুরস্কারের অর্থ আমাকেই দিয়ে দিক না!” মার্কিন বিদেশ দফতরের এক মুখপাত্র রাতে পাল্টা বলেন, “সবাই জানেন হাফিজ সইদ কোন এলাকায় লুকিয়ে আছেন। আমরা শুধু সেই সব তথ্যপ্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করছি যেগুলো আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে।” মুম্বই সন্ত্রাসের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই বলে দাবি করে হাফিজের পাল্টা অভিযোগ, আমেরিকা ভারতের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে এই ভাষায় কথা বলছে। পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে আফগানিস্তানে ন্যাটোর রসদ সরবরাহের রাস্তা আবার খোলার জন্যই আমেরিকার এই কৌশল। রাওয়ালপিন্ডির সেনা ছাউনির কাছে বসে হাফিজের এই সাংবাদিক বৈঠক করার অর্থ, সফরের আগে এ ব্যাপারে পাক প্রেসিডেন্টের উপর চাপ সৃষ্টি করা।
চাপ তৈরি করতে চাইছে আমেরিকাও। কারণ, মুম্বই সন্ত্রাসের পর তিন বছর কেটে গিয়েছে। ওসামা বিন লাদেনও নিহত হয়েছেন প্রায় এক বছর আগে। আজ এত দিন পর মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শেরম্যান হঠাৎ নয়াদিল্লির মাটিতে দাঁড়িয়ে হাফিজ সম্পর্কে এই তথ্য খোলসা করতে গেলেন কেন? আমেরিকার উদ্দেশ্য কী? আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের ওপর ওবামার নির্ভরশীলতা এখনও প্রবল। তবে বিভিন্ন কারণে আমেরিকা-পাক সম্পর্কও এখন খুব খারাপ।
ভারত মনে করছে, পাকিস্তানকে চাপের মধ্যে রেখে কূটনৈতিক দরকষাকষি করা আমেরিকার লক্ষ্য। কিন্তু ভারত সেই উদ্দেশ্যকে অগ্রাধিকার না দিয়ে নয়াদিল্লির অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জারদারির সঙ্গে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। পাক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রেহমান মালিকের সঙ্গে পি চিদম্বরমের আলোচনায় কিছু গোপন তথ্য বিনিময় হতে পারে ঠিকই, কিন্তু জারদারির সফরকে ঘিরে অতিরিক্ত শোরগোল চান না মনমোহন সিংহ। দেশের ভিতর আমজনতার জন্য তিনি পাক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেবেন বটে, কিন্তু জারদারি হাতের তাস আপাতত তাঁকে কতটা দেখাতে রাজি হবেন, সেটাই তিনি আগে বুঝে নিতে চান। |