ডাইনি অপবাদে তার মাকে খুন করতে কিছু লোক ছুটে আসছে দেখে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী বলেছিল, ‘মা, তুমি পালিয়ে যাও।’ সে কথা শুনে মেয়েকে ঘরে রেখে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন মনো দেবী। দুষ্কৃতীরা গিয়ে মনোদেবীকে না-পেয়ে চামেলিকেও পিটিয়ে, বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুন করে বলে অভিযোগ। তার পরে প্রতিবেশী ফুলমণি হাঁসদা(৪০) নামে আরেক মহিলাকেও পিটিয়ে ও কুপিয়ে খুন করে তারা। পাশাপাশি, ডাইনি সন্দেহে আরতি সোরেন নামে আরেক মহিলার ওপরেও হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা। তিনি অবশ্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়েছে। সোমবার রাতে রায়গঞ্জ ব্লকের বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েতের আগাবহর গ্রামে ওই ঘটনার পরে ২৪ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। কিন্তু, দুষ্কৃতীরা কেউ ধরা পড়েনি। তাই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে এলাকার বাসিন্দারা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। এমনকী, গ্রাম পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ ও উত্তর দিনাজপুর জেলা শিশুকল্যাণ কমিটির সদস্যরাও পুলিশের সমালোচনা করেছেন। রায়গঞ্জ থানার আইসি সুবীরকুমার পাল বলেন, “অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্তদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে অভিযুক্ত ও তাদের পরিবারের লোকজন সবাই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। তাদের গ্রেফতার করা হবে।” |
বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ প্রধান মনসুর আলি জানান, পুলিশের কাছে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়েছে। জেলা শিশু কল্যাণ কমিটির চেয়ারপার্সন সুনীলকুমার ভৌমিক বলেন, “আমরা বাসিন্দাদের মধ্যে কুসংস্কারের বিরোধী প্রচার চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” এ দিন ব্লক প্রশাসনের কর্তারা ও জেলা শিশুকল্যাণ কমিটির সদস্যরা এলাকা পরিদর্শন করে বাসিন্দাদের কুসংস্কার মুক্ত হওয়ার আর্জি জানান। কমিটির সদস্য তথা জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক নারায়ণচন্দ্র ঘোষ বলেন, “এলাকায় পুলিশ পিকেট বসানো হলেও দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে পুলিশকে তৎপর হতে দেখা যাচ্ছে না।” পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই আদিবাসী পাড়ায় ১৫ পরিবারের বসবাস। গত এক সপ্তাহে আদিবাসী পাড়া এলাকার বাসিন্দা দুবাই মুর্মু নামে এক ব্যক্তি ক্যানসার ও সুমি কিস্কু নামে এক মহিলা কিডনির সমস্যা জনিত অসুখে ভুগে মারা যান। ওই দুজন অবশ্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাতুড়ে চিকিৎসকের ওষুধ খেয়েছেন। ওই দুজন মারা যাওয়ার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ ফুলমণি দেবী, চামেলির মা মনো সোরেন ও আরতি দেবীকে ডাইনি বলে অপবাদ দেয়। তার পরেই হামলা হয়। দুষ্কৃতীরা ওই বালিকা এবং ওই মহিলাকে খুন করার পর মৃতদেহ দুটি টেনে হেঁচড়ে বাড়ি থেকে প্রায় ৩০ মিটার দূরের এলাকার একটি জমির পাশে নিয়ে গিয়ে সেখানেই রেখে পালিয়ে যায়। মনোদেবী বলেন, “মেয়ে আমাকে বাঁচিয়ে নিজেই দুষ্কৃতীদের হাতে মারা গেল। ঘটনার সময়ে মনোদেবীর স্বামী মোটাইবাবু ও তিন ছেলেমেয়ে এলাকার একটি পুজোর মেলা দেখতে গিয়েছিলেন। নিহত ফুলমণি দেবীরও দুইছেলে দুই মেয়ে রয়েছে। তাঁর স্বামী পেশায় মাছ ব্যবসায়ী সোম হাঁসদা বলেন, “দুষ্কৃতীরা আমার ছোটছেলে ঠাকুরের সামনেই আমার স্ত্রীকে ডাইনি খুন করে। ঠাকুর পুলিশের কাছে স্থানীয় ৮ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে।” এলাকার সিপিএম বিধায়ক খগেন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “কুসংস্কার রাজ্যের সর্বত্রই রয়েছে। বাসিন্দাদের কুসংস্কার দূর করতে দলের তরফে নিশ্চয়ই সচেতনতা অভিযান চালানো হবে।” জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক পবিত্র চন্দ ও তৃণমূল রাজ্য সম্পাদক অসীম ঘোষ প্রায় একই সুরে দীর্ঘ বাম শাসনে কুসংস্কার বিরোধী প্রচার না-হওয়াকেই ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন। তবে তাঁরাও কুসংস্কার বিরোধী প্রচারে নামার কথা জানিয়েছেন। জেলাশাসক পাসাং নরবু ভুটিয়া বলেন, “বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাহায্যে খুব শীঘ্রই প্রশাসন বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় কুসংস্কার বিরোধী প্রচারে নামবে।” |