স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে ডাক্তারদের মূলমন্ত্র একটাই। শরীরে রোগ বাসা বাধার আগেই সতর্ক হোন। কিন্তু কী ভাবে? সম্প্রতি এক দল বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, তাঁরা এমন একটি জিন খুঁজে পেয়েছেন, যা সহজেই বলে দিতে পারবে কোনও মহিলার বংশে স্তন ক্যানসার থাকলে তাঁরও একই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে কি না। ‘আমেরিকান জার্নাল অফ হিউম্যান জেনেটিকস’ নামের একটি পত্রিকায় তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের আন্তর্জাতিক দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা মেলিসা সৌদি। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক ‘জিন সিকোয়েন্সিং’ প্রযুক্তির মাধ্যমে তাঁরা ‘এক্সআরসিসি২’ জিনটির সন্ধান পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন মেলিসা। তাঁর বক্তব্য, এক পরিবারের অনেকেই স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। কিন্তু বংশগত কারণেই তাঁদের এই রোগ হয়েছে কি না, সেটা এত দিন স্পষ্ট করে বলা যেত না। সে কথাই জানাতে সাহায্য করবে এই এক্সআরসিসি২ জিনটি।
বংশে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলেই চিকিৎসকদের প্রথম হুঁশিয়ারি, ‘সাবধান’! “কিন্তু কি ভাবে সাবধান হব? জানব কী করে, কর্কট রোগ আমার শরীরেরও বাসা বাঁধছে?” প্রতি মুহূর্তে এই আশঙ্কায় ভুগছেন, এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
বিজ্ঞানীদের দাবি, মূলত এক্সআরসিসি২-র গঠনে আচমকা পরিবর্তনই (মিউটেশন) স্তন ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। গবেষক দলটির এক সদস্যের কথায়, “প্রায়শই দেখা যায়, একটি পরিবারের অনেকে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। আবার ওই পরিবারেরই কোনও এক জনের দেহে এখনও ছোবল মারেনি স্তন ক্যানসার। কিন্তু বংশগত সূত্রে পাওয়া পরিবর্তিত এক্সসিসিআর২ জিনটি রয়েছে তাঁর শরীরেও। অর্থাৎ, যে কোনও দিন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন তিনি।”
এত দিন এক্সআরসিসি২-র কথা জানাই ছিল না। জানা ছিল না এর আচমকা পরিবর্তনের ফলে কী করে স্তন ক্যানসার ক্রমশ জাঁকিয়ে বসে শরীরে। মেলিসার দাবি, বংশানুক্রমিক ভাবে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত কোনও পরিবারের সদস্যদের এক্সসিসিআর২-র গঠন পরীক্ষা করে দেখলেই তাঁদের কারও ওই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে কি না, তা জানা সম্ভব হবে। আর প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে, স্তন ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের।
স্তন ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে তা নিরাময়ের ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় বেশি আশাবাদী ওই বিজ্ঞানী দলেরই সদস্য শন ট্যাভটিজিয়ান। তাঁর দাবি, এক্সসিসিআর২-এর যে ধরনের মিউটশনে স্তন ক্যানসারের আশঙ্কা দেখা দেয়, ‘পার্প’ নামে এক ধরনের ওষুধের সাহায্যে তার নিরাময় সম্ভব। ওই ক্যানসার কোষগুলিকে ধ্বংস করে দেয় ‘পার্প’।
কী করে এই জিনটির খোঁজ মিলল? ‘ম্যাসিভলি প্যারালাল সিকোয়েন্সিং’ পদ্ধতিতে এই জিনটিকে চিহ্নিত করেছেন মেলিসা ও তাঁর সঙ্গীরা। ‘সিকোয়েন্সিং’ পদ্ধতিতে ডিএনএ-এর কোনও একটি নির্দিষ্ট অংশের গঠন জানা সম্ভব। এ ভাবেই ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলির জিনের গঠন নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু যে পদ্ধতিতে ‘সিকোয়েন্সিং’ করা হয়, তা খুবই সময়সাপেক্ষ। ‘ম্যাসিভলি প্যারালাল সিকোয়েন্সিং’-র সাহায্যে খুব দ্রুত একটি নির্দিষ্ট সময়ে ডিএনএ-র অনেকগুলি অংশের (ফ্র্যাগমেন্ট) গঠন এক সঙ্গে জানা যায়। সেই কারণেই তাঁদের গবেষণায় এই পদ্ধতিটিই বেছে নেন মেলিসারা।
ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসারের প্রবণতা ক্রমে বাড়ছে। জরায়ুমুখ ক্যানসার হানার আগেই ‘প্যাপ স্মিয়ার’ পদ্ধতিতে তার আভাস পাওয়া সম্ভব। কিন্তু স্তন ক্যানসার হতে চলেছে কি না, তা আগাম জানার কোনও উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে ওই জিনের খোঁজ স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় যুগান্তকারী বলে প্রমাণিত হতে পারে।”
মেলবোর্নের গবেষকদের দাবি, এক্সআরসিসি২-এর আবিষ্কার শুধু স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রেই সাফল্য আনেনি, একই সঙ্গে প্রমাণ করে দিয়েছে, নয়া ‘সিকোয়েন্সিং’ পদ্ধতি কোলোরেকটাল (মলাশয় বা অন্ত্রের যে কোনও অংশ) বা প্রস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। |