ভূমি সংস্কার আইন সংশোধন
জমি-জট কাটাতে এক কদম এগোল রাজ্য
শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি লেনদেনের ক্ষেত্রে আইনি বাধা অনেকটাই সরিয়ে দিল রাজ্য সরকার। ফলে এ রাজ্যে জমি-জটে আটকে থাকা বিনিয়োগের আকাশে আশার সঞ্চার হয়েছে। তাঁরা ক্ষমতায় আসার দশ মাসের মধ্যেই বড়, ছোট, মাঝারি শিল্প মিলিয়ে রাজ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে বলে দাবি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের। কিন্তু জমি পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ দিন রাজ্য ভূমি সংস্কার আইনের যে সব সংশোধনী আনা হল, তাতে সরকার সেই সমস্যা অনেকটা মেটাতে পারবে বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রশাসনিক মহলের একাংশের অভিমত, যে জমি-জটিলতা শিল্পোদ্যোগীদের ‘বিমুখ’ করছিল, তার সমাধানে এটি একটি ‘ইতিবাচক পদক্ষেপ’। একই সঙ্গে তাঁরা জানাচ্ছেন, এতেই ‘সন্তুষ্ট’ না-থেকে সরকারের উচিত এ ব্যাপারে আরও ‘উদ্যোগী’ হওয়া। তবে এ দিনের পদক্ষেপ যে ‘শুরু’ হিসেবে খারাপ নয়, তা-ও তাঁরা জানিয়েছেন।
জমি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরোধী। এই বিষয়টি সামনে রেখে দ্রুত জমি নীতি তৈরি করলেও রাজ্যের পৃথক জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন আইন এখনও বিধানসভায় পেশ করা যায়নি। তেমনই শেষ হয়নি জমি-ব্যাঙ্ক তৈরির কাজও। রাজ্যে বিনিয়োগের পথে জমিই যে এখন বড় বাধা, সে কথা উঠে এসেছে বণিকসভা সিআইআই ও বিশেষজ্ঞ সংস্থা আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, শুধু নতুন বিনিয়োগই যে আসছে না, তা নয়, আটকে গিয়েছে পুরনো শিল্পের সম্প্রসারণ পরিকল্পনাও। এই অনিশ্চয়তা দূর করতে সিআইআই-এর দাওয়াই, সার্বিক একটি জমি নীতি প্রণয়ন করা জরুরি।
সোমবার মহাকরণ থেকে বেরোচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। নিজস্ব চিত্র
সোমবার এই সংশোধনের মধ্যে সেই অনিশ্চয়তা অনেকাংশেই কেটে যাওয়ার দিশা রয়েছে বলে মনে করছে শিল্প তথা বণিকমহল। এই সংশোধনে তারা সামগ্রিক ভাবে খুশিও। শিল্পমহলের ব্যাখ্যা, এর ফলে জমি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের হেনস্থা কমবে। ভিসা স্টিলের কর্তা বিশ্বেশ্বর সরন জানান, জমির সঠিক ব্যবহারের পথ দেখাতে পারলে লগ্নি টানা কঠিন কাজ হবে না। তিনি বলেন, “জমি নিয়ে নির্দিষ্ট নীতি তৈরি হলে বিনিয়োগকারী স্বস্তিতে থাকবেন। ফলে রাজ্য সরকারের প্রতি আস্থা বাড়বে। বাড়বে বিনিয়োগ।” বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্সের অন্যতম কর্তা সন্দীপ সেন জানান, জমি নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটলে লগ্নি নিয়েও অনিশ্চয়তা কাটবে। তিনি বলেন, “জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার যে ছাড় দিয়েছে, তা শিল্পের জন্য জরুরি।” প্রায় একই সুরে এই সংশোধনকে স্বাগত জানিয়েছে বণিকসভা ফিকি। তাদের বক্তব্য, এই ছাড়ের ফলে নতুন ধরনের শিল্প গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হবে।
বেশ কিছু শিল্প ক্ষেত্রকে সিলিংয়ের বেশি জমি রাখার এবং কিছু ক্ষেত্রে ‘ছাড়’ দেওয়ার যে ব্যবস্থা করেছে সরকার, তাতে জমির সমস্যা অনেকটাই মিটবে বলে আশাবাদী শিল্প দফতরও। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “সংশোধনীতে যে সব পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, সব ক্ষেত্রেই মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিগোষ্ঠীর কমিটিতে তা অনুমোদন করাতে হবে। আমরা কেস-টু-কেস বিবেচনা করে অনুমোদন দেব।”
সংশোধন একনজরে
শিল্প পার্ক, হাব, অর্থতালুক, জৈব প্রযুক্তি ও ফুড পার্ক তৈরির জন্য সরকারের অনুমতি নিয়ে যে কোনও জমির মালিক জমি ‘লিজ’ দিতে পারবেন
সরকারি সংস্থা বা স্থানীয় প্রশাসন ‘টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি প্ল্যানিং’ আইন অনুযায়ী উপনগরী তৈরির জন্য জমি ‘লিজ’ দিতে পারবে
যেখানে আইন ভেঙে জমির চরিত্র বদল হয়েছে, সেখানে জরিমানা দিয়ে ‘নিয়মিত’ করার সুযোগ, তবে একবারই
পুরনোর সঙ্গে কিছু নতুন ধরনের শিল্প ক্ষেত্রের জন্য সিলিংয়ের বেশি জমি রাখার অধিকার
বন্ধ ও রুগ্ণ কারখানার জমি নিলাম করে বিক্রি করতে পারবে সরকার
সোমবার, বিধানসভার বাজেট অধিবেশনের শেষ দিন রাজ্য ভূমি সংস্কার আইনে (১৯৫৫) ছ’টি সংশোধনী আনা হয়েছে।
• ৪ নম্বর ধারা সংশোধন করে বলা হয়েছে, কোনও মালিক (রায়ত) তাঁর জমির পুরো অথবা অংশ শিল্প-পার্ক, হাব, এস্টেট, অর্থতালুক, জৈবপ্রযুক্তি পার্ক ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প নির্মাণের জন্য ‘লিজ’ দিতে পারবেন। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর সব দিক খতিয়ে দেখে অনুমোদন দেবে। একই ভাবে, পঞ্চায়েত-পুরসভার মতো স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারি সংস্থা ‘টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি প্ল্যানিং’ আইন অনুযায়ী উপনগরী তৈরির জন্য জমি ‘লিজ’ দিতে পারবে।
• ৪সি ধারা সংশোধন করে বলা হয়েছে, আগে যে সব জায়গায় আইন না মেনে জমির চরিত্র বদল বা ‘কনভারশন’ হয়েছে, সে সব ক্ষেত্রে ‘জরিমানা’ নিয়ে সরকার তা ‘আইনি’ করে দেবে। তবে পার্থবাবু বলেছেন, “এটা এককালীন সুবিধা। নতুন কেউ এই সুবিধা পাবে না।”
• ১৪কে ধারা সংশোধন করে বলা হয়েছে, প্রকল্প রিপোর্ট সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর খতিয়ে দেখে তবেই অনুমোদন দেবে।
• ১৪ওয়াই ধারা সংশোধন করে বলা হয়েছে, বেশ কিছু শিল্প ক্ষেত্রের জন্য সিলিংয়ের বেশি (২৪.২২ একর) জমি রাখার অনুমতি দেবে সরকার। এই ধারার আওতায় আগে সাতটি ক্ষেত্রকে ছাড় দেওয়া হয়। সংশোধনের পরে তালিকা থেকে ‘উপনগরী প্রকল্প’ বাদ পড়েছে। যুক্ত হয়েছে অন্য বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র। সেই তালিকায় এখন থাকছে মিল, কারখানা বা ওয়ার্কশপ, পোল্ট্রি-ফার্ম, ডেয়ারি, চা-বাগান, শিল্পপার্ক-হাব-এস্টেট, অর্থতালুক, বিদ্যুৎপ্রকল্প, পর্যটনশিল্প, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট, ফিল্মসিটি, জৈবপ্রযুক্তি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বিমানবন্দর, জাহাজ তৈরির যন্ত্রাংশ, তেল ও গ্যাস প্রকল্প, তথ্য ও পরিষেবা প্রযুক্তি, খনিজ সামগ্রী, ওয়্যারহাউসিং ইত্যাদি। কারও হাতে আগে থেকেই সিলিংয়ের চেয়ে বেশি জমি থাকলে সংশোধিত আইন অনুযায়ী ওই ব্যক্তি বা সংস্থা সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে নিম্নলিখিত প্রকল্পের জন্য জমি লিজ দিতে পারবে। সেগুলি হল: শিল্পপার্ক-হাব-এস্টেট, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, অর্থতালুক ও জৈবপ্রযুক্তি। তবে জমি লিজের তিন বছরের মধ্যে কাজ শুরু না-করলে তা ফিরিয়ে নেবে সরকার।
• ১৪আর ধারায় বলা হয়েছে, পঞ্চায়েত ও পুরসভার মতো সরকারি কোনও সংস্থা সিলিংয়ের বেশি জমি রাখতে পারবে।
• ১৪জেড ধারায় বলা হয়েছে, রুগ্ণ ও বন্ধ কারখানার জমি ‘নিলাম’ করে বিক্রি করতে পারবে সরকার। তবে চা-বাগানের ক্ষেত্রে তা করা যাবে না। যে সব ক্ষেত্রে এমন জমি বিক্রি করা হবে, সেখানে প্রাপ্ত অর্থ থেকে কর্মীদের বকেয়াও মেটানো হবে।
সংশোধনী বিলটি উত্থাপন করার কথা ছিল ভূমি দফতরের মন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার। কিন্তু তিনি সভায় না-থাকায় বিলটি উত্থাপন করেন শিল্পমন্ত্রী। তাতে বিরোধীরা উষ্মা প্রকাশ করায় পার্থবাবু বলেন, “আমি বিষয়টি জানি বলেই বিলটা এনেছি।”
দীর্ঘ আলোচনার জন্য বিলটিকে ‘সিলেক্ট কমিটি’তে পাঠানোর আর্জি জানান বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, “২০০৬ সালে ভূমিসংস্কার আইনের উপর আমরাও একটি সংশোধনী বিল আনতে চেয়েছিলাম। বিরোধীদের দাবি মেনে সেটি সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়। অনেক আলোচনার পরেও বিলটি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছনো যায়নি বলে সেটি বাতিল করে দেওয়া হয়।” সরকারকে সতর্ক করে তিনি বলেন, “কৃষি থেকে শিল্পের পথে যেতে হবে। অর্থাৎ, কৃষিনির্ভর মানুষের জীবনযাপনের মান আরও উন্নত করতে হবে। উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাটা জটিল বিষয়। ভারসাম্যে ছোট্ট ভুল হলে কিন্তু বিপর্যয় হয়ে যাবে। তাই অনেক আলোচনা প্রয়োজন। অধিবেশনের দেড় ঘণ্টায় তা হতে পারে না।” শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটিতে (১৫২-৪৬) পরাস্ত হয় সূর্যবাবুদের বিরোধিতা।
বামেদের অভিযোগ, চাষযোগ্য জমি অধিগ্রহণ করা হবে না বলে সরকার দাবি করছে। আবার তারাই লগ্নিকারীদের হাতে অবাধে জমি তুলে দিতে চাইছে। এর ফলে প্রোমোটার-রাজ কায়েম হবে। সূর্যবাবু বলেন, “ব্যক্তিকে সিলিংয়ের বেশি জমি রাখার ছাড়পত্র দেওয়ার অর্থ জমিদারি ব্যবস্থাকেই মনে করিয়ে দেওয়া!” জবাবে পার্থবাবু বলেন, “সরকারের নীতি, জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। আমরা কৃষিকে বাঁচিয়ে শিল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।”
পরেও পার্থবাবু বলেন, “একাধারে শিল্প ও কৃষির উন্নয়নের জন্যেই সংশোধিত বিল এনেছি।” বিনিয়োগের এই পথ প্রশস্ত করতে কৃষিজমিতে হাত পড়বে না বলেও দাবি করেন তিনি। শিল্পের জন্য জমি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ‘সতর্ক’ থাকবে বলে জানিয়ে পার্থবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৭ মন্ত্রীকে নিয়ে কমিটি হয়েছে। কী শিল্প করা হবে, বিশদ প্রকল্প রিপোর্ট-সহ অন্য তথ্য খতিয়ে দেখবে কমিটি। সেই সঙ্গে যারা জমি কিনছে, তারা ঊর্ধ্বসীমার বাইরে কত জমি রাখছে, তা খতিয়ে দেখেই কমিটি সবুজ সঙ্কেত দেবে।” বাম আমলে যে সব বাণিজ্যগোষ্ঠীকে বাড়তি জমি দেওয়া হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে একটি পেশাদারি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে পার্থবাবু জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, বন্ধ কারখানা চালু করার ব্যাপারে রাজ্য ‘পিপিপি মডেলে’ যেতে আগ্রহী। তিনি বলেন, “এ রাজ্যে যাঁরা নতুন কারখানা খুলতে আসছেন, তাঁদের কাছে নতুনের সঙ্গে একটা পুরনো বন্ধ কারখানা চালু করার আর্জিও জানাচ্ছি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.