|
|
|
|
সম্পাদক সমীপেষু... |
ফরাক্কা বাঁধ তো মৃতপ্রায় |
১৯৫৬ সালে সেন্ট্রাল পাওয়ার অ্যান্ড ওয়াটার কমিশন যখন ফরাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পের নকশা তৈরি করে, তখন গঙ্গা নদী ছিল পরিপূর্ণ, জলবতী। ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা সরেজমিনে ফরাক্কা পরিদর্শন করে বাঁধ নির্মাণের সুপারিশ করেন। কিন্তু অর্ধ শতাব্দী যেতে না যেতেই প্রকল্পটি মৃতপ্রায়। বর্ষা ছাড়া বছরের অন্য সময়ে গঙ্গার মূল জলধারা পদ্মা বেয়ে বাংলাদেশে চলে যেত বলে ভাগীরথী শুকিয়ে যেত। মনে পড়ে, ষাটের দশকে আমরা বছরে ৯ মাস পায়ে হেঁটে ভাগীরথী পার হতাম। ভাগীরথীকে সারা বছর ‘প্রবাহিণী’ রেখে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর জন্য এই প্রকল্পের পরিকল্পনা। সে জন্যই ফরাক্কা থেকে আহিরণ ব্যারেজ (পোশাকি নাম জঙ্গিপুর ব্যারেজ) পর্যন্ত সাড়ে ৪২ কিলোমিটার ফিডার ক্যানেল (৭৬ মিটার প্রশস্ত) কেটে ফরাক্কার জলকপাট (প্রতিটি কপাট ২৮.২৯ মিটার লম্বা) দ্বারা অবরুদ্ধ গঙ্গার জলকে শুকনো ভাগীরথীতে পাঠাবার ব্যবস্থা হল। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ফিডার ক্যানেল চালু হয়। তার তিন দিন আগে ফিডার খাল চালু হওয়ার বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি হয়। এই ক্যানেল দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৪০ হাজার কিউসেক জল পাঠানো হবে এই ছিল চুক্তি। কেননা, কলকাতা বন্দরকে সচল রাখার জন্য ঠিক এই পরিমাণ জলই দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছিলেন।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর থেকে যত দিন গড়াচ্ছে আঙ্কিক হিসেব যাই বলুক না কেন, ‘বাস্তবে’ ভাগীরথীতে জল প্রবাহের পরিমাণ অনেক কমেছে। একটাই কারণ, পরে ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গার জল চুক্তির জন্য বেশ কিছু জল পদ্মায় ছেড়ে দেওয়া। তা ছাড়া ২০১১ সালের ২৬ জুন ১৩ নম্বর গেট এবং ৯ ডিসেম্বর ১৬ নং গেট ভেঙে যাওয়ায় অপরিকল্পিত ভাবে আরও বেশ খানিকটা জল বাংলাদেশে বেরিয়ে যাওয়া। ফরাক্কা ব্যারেজের জলধারণ ক্ষমতা ৮ কোটি ৭০ লক্ষ ঘনমিটার। ফরাক্কায় জলস্তরের উচ্চতা থাকার কথা ৭২ ফুট। কিন্তু বর্তমানে তা ৬৫.৮ ফুট। এর জন্য একমাত্র দায়ী করা হচ্ছে ১৩ ও ১৬ নম্বর গেট ভেঙে যাওয়াকে। তা কিন্তু নয়। ২.২৪ কিলোমিটার লম্বা ফরাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি জলকপাটের মধ্যে মাত্র দুটি ভেঙে গেলে জলস্তর এত নীচে নামার কথা নয়। ১৯৭৫-এর পর থেকে একটু একটু করে ফরাক্কার জলস্তর অনেকটা নেমে গেছে। তার কারণ, গঙ্গার বুকে পলি জমে জলধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং উত্তর ভারতে গঙ্গাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নানান নদী প্রকল্প। এটাই বোধহয় গঙ্গার নিয়তি। |
|
মৃতপ্রায়? ফরাক্কা বাঁধ প্রকল্প। |
আর একটা কারণ, দামোদর ও ময়ূরাক্ষী প্রকল্পের সার্থকতা এবং ভাগীরথীর নাব্যতা কমে যাওয়া। ফিডার ক্যানেল চালুর সময়েই ফরাক্কা নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, কলকাতা পোর্ট কমিশনার্স এবং কেন্দ্রীয় সেচ দফতরের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা বিশেষ সংস্থা গঠিত হয়েছিল। তাদের দায়িত্ব ছিল জঙ্গিপুর থেকে চব্বিশ পরগনার স্বরূপনগর পর্যন্ত ২৫৭.৬০ কিলোমিটার নদীপথে পলি অপসারণ ও নাব্যতা রক্ষার জন্য নদীস্রোতের সার্বিক পরীক্ষা করা। ওই সংস্থা এই দীর্ঘ সময় জুড়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি বলে ভাগীরথী ও হুগলি নদীর জলধারণ ক্ষমতা অনেক কমে গেছে।
শুধু ফরাক্কা নয়, এই প্রকল্পের অধীনে জঙ্গিপুরের কাছে আহিরণে ভাগীরথীর উপর যে ব্যারেজটি তৈরি হয়েছে, তার উদ্দেশ্য ছিল পদ্মার বাড়তি জল যতে ফিডার ক্যানেল-বাহিত ভাগীরথীর জলস্তরকে বিপজ্জনক ভাবে বাড়িয়ে না-দেয় কিংবা শুখা মরসুমে ফিডার ক্যানেলের জল পদ্মার দিকে বেরিয়ে না-যায়, তা নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু বহু কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই বাঁধটি উভয় দিকের জল নিয়ন্ত্রণে এখন কোনও কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না। কেননা, বর্তমান পদ্মা ভাগীরথীর সংযোগস্থল (স্কুলপাঠ্য ভূগোলে এখনও যা ‘ধুলিয়ানের কাছে’ বলেই উল্লিখিত) গিরিয়ার খেজুরতলা ঘাট থেকে আহিরণ ব্যারেজ পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার ‘অব্যবহৃত’ ভাগীরথীর সমতল বুকের উপর এখন ধানচাষ হচ্ছে। মাত্র ৩০/৪০ বছরে পরিপূর্ণা ভাগীরথী একটু একটু করে মজে গিয়ে সমতল জমিতে পরিণত হয়েছে। শুধু আহিরণ ব্যারেজের জলকপাটের ফাঁক দিয়ে গলে পড়া কিছু জল একটা ছোট্ট খাঁড়ি বেয়ে পদ্মায় গিয়ে পড়ছে। এই মজে যাওয়া ‘বাতিল’ ভাগীরথী সংস্কার না হলে আহিরণ ব্যারেজের জলকপাটিকা, তার পাশেই ছোট স্টিমার পারাপারের জন্য বহু সাধের মজবুত ‘লক গেট’ সব কিছুই ‘ইতিহাসের দর্শনীয় বিষয়’ হয়ে থেকে যাবে। পদ্মার সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী ভাগীরথী যদি মজে গিয়ে সমান হয়েই যায়, তা হলে আহিরণ ব্যারেজের সার্থকতা কতটুকু?
তা হলে ভাগীরথী তথা হুগলি নদীর ভবিষ্যৎ কী? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ১৯৭৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গার জলচুক্তি স্বাক্ষরের দিনে। সে দিনের চুক্তিতে চারটি পয়েন্ট ছিল:
১) ২১ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল এই ১০ দিন ভারত পাবে ২০,৮০০ কিউসেক জল আর বাংলাদেশ পাবে ৩৪,৭০০ কিউসেক জল।
২) ১ মে-র পর থেকে ভারত যাতে ফিডার ক্যানেল দিয়ে ৪০,০০০ কিউসেক জল পাঠাতে পারে, তার জন্য জল সরবরাহ ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হবে।
৩) স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে ফরাক্কার নীচে স্থানীয় ব্যবহারের জন্য ভারত কিছু পরিমাণ জল নিতে পারবে।
৪) দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের সংযোগ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করে দেখা হবে।
এই আপাত-নিরীহ শেষ বিষয়টি আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আজ ৩৫ বছর ধরে চুক্তির এই চতুর্থ পয়েন্টটি মোটেই যৌথ গুরুত্ব পায়নি। অবশ্য ভারতের প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্পের খসড়ায় ব্রহ্মপুত্রের জলকে শিলিগুড়ির কাছে তিস্তা ভেদ করে ফরাক্কা, দুর্গাপুর হয়ে মহানদী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। সে যাই হোক, ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে গঙ্গার সংযোগসাধন ছাড়া গঙ্গাকে বাঁচানোর আর কোনও উপায় নেই। আর গঙ্গা না-বাঁচলে ভাগীরথীও বাঁচবে না। ব্রহ্মপুত্র যে বিপুল পরিমাণ জল বহন করে, তা অনেকটা অপচয়িত হয় প্রায় প্রতি বছর অসম ও বাংলাদেশের ভয়াবহ বন্যায়। সেই জল যদি গঙ্গা ‘কিছুটা’ পায়, তা হলে অসমের বন্যার প্রবণতা যেমন কমবে, তেমনই পর্যাপ্ত জলপ্রবাহ পেয়ে ভাগীরথী তথা হুগলি নদীও উজ্জীবিত হবে। বাঁচবে কলকাতা বন্দর-সহ সমগ্র কলকাতা। |
সাধন দাস। ভৈরবটোলা, লবণচোয়া, মুর্শিদাবাদ
|
শিরীষ গাছের গণমৃত্যু |
|
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য |
শ্যামল বঙ্গপ্রকৃতির এক অতিপরিচিত বৃক্ষ শিরীষ। সমভূমি থেকে পার্বত্য অঞ্চল সর্বত্র এই ঝাঁকড়া ছায়াপ্রদায়ী বৃক্ষের উপস্থিতি। গত এক-দেড় বছর ধরে অত্যন্ত বেদনা ও আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করছি, শিরীষ বৃক্ষগুলি শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। কোনা এক্সপ্রেসওয়ের ধারে এ রকম অনেক শিরীষের কঙ্কাল চোখে পড়ে। জগাছা প্রেস কোয়ার্টার্সের একদা দৃষ্টিনন্দন শিরীষবন বর্তমানে বীভৎস কঙ্কাল-উদ্যানে পরিণত। আমতা শাখার বাঁকড়া নয়াবাজ প্ল্যাটফর্ম ও রেললাইন বরাবর সার দিয়ে দণ্ডায়মান বৃহদাকার শিরীষের জীর্ণ কঙ্কাল, পিজি হাসপাতালের উল্টো দিকে বিবেকানন্দ উদ্যানে সারিবদ্ধ শুষ্ক মৃত বৃক্ষগুলি মানব জাতিকে উপহাস করার জন্যই যেন দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
শিরীষ অন্যান্য গাছের তুলনায় বেশি আলোকসংবেদী। হয়তো এদের দূষণ-সহ্যক্ষমতা অন্যান্যদের তুলনায় কম। হয়তো বাতাসে বিশেষ কোনও পদার্থের উপস্থিতি বা কোনও উপাদানের অতিরিক্ত উপস্থিতি এরা সহ্য করতে পারছে না। পরিবেশ বিজ্ঞানী ও উদ্ভিদবিদদের কাছে অনুরোধ, এই উদ্ভিদ-মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে সচেষ্ট হন। প্রশাসনের কাছে অনুরোধব্যাপারটি গুরুত্ব সহযোগে বিবেচনা করা হোক। |
সুশীলকুমার বর্মন। অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর,
গোয়েন্কা কলেজ অব কমার্স অ্যান্ড বি এ, কলকাতা-১২
|
পুজোর নামে অত্যাচার! |
সরস্বতীর ভাসানে তারস্বরে মাইক, প্রহৃত, ইটে চোখও জখম’ (৬-২) খবর দেখে, বিশেষ করে আহত ব্যক্তির রক্তাক্ত ছবি দেখে যে-কোনও মানুষই কষ্ট পাবেন। তবে খবর পড়ে খুব বেশি অবাক হইনি। কারণ, বেশ কয়েক বছর যাবৎ বিশেষত গত দুটি দশকে গ্রামের অর্থনৈতিক চেহারার দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু, সমস্ত মাঠঘাট, রাস্তার মোড়ে কোনও-না-কোনও দেবদেবীর মূর্তি বসিয়ে স্থান-মাহাত্ম্য বদলে ফেলা হয়েছে। এখন গ্রামে একটি ক্লাব সকলের মনের চাহিদা মেটাতে পারছে না। ফলে পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠছে নানা ধরনের ক্লাব, সংগঠন। আর পাঁচটা বাঙালি ছেলে একত্র হলেই একটা পুজো অবধারিত। রাস্তায় গাড়ি আটকে চাঁদা তোলা এখন আর ‘তোলা আদায়’ নয়, যথেষ্ট রীতি। হাওড়া, হুগলি জেলায় আবার ঠাকুরের বেদিতে গঙ্গাজল ঢালার ঢালাও ব্যবস্থা। তার জন্য ভ্যানগাড়িতে পঞ্চাশটি মাইক ও বক্স লাগিয়ে তারস্বরে গান। শব্দদূষণের শিকারে অভ্যস্ত গ্রামের মানুষ নীরবে সব কিছু সহ্য করে চলে। গ্রামে এখন বারো মাসে চব্বিশ পার্বণ, বা আরও হয়তো বেশিই হবে। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না। কোন ক্লাব কবে বিসর্জন করবে সেটা তাদের ইচ্ছাধীন। প্রতিটি পুজোকে ঘিরে মাইকের তাণ্ডব আর লাইসেন্সবিহীন চোলাই মদের উৎপাত। শব্দদূষণ রোধ করতে প্রতিটি মাইক ব্যবসায়ীকে কঠোর ভাবে শব্দের মাত্রা মেনে চলতে বাধ্য করা দরকার। |
সন্দীপ সিংহ। প্রধান শিক্ষক, জামাইবাটি উচ্চ বিদ্যালয়, হুগলি
|
(মহা)পুরুষ! |
যা দেখি, যা শুনি, মনে মনে কথা বলি’ (৭-৩) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘মহাপুরুষদের ঈর্ষা হয়’! এ প্রসঙ্গে বলা বাহুল্য, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন কিছু করেছেন যা ঈর্ষার চাইতেও ভয়ঙ্কর। যেমন, কাদম্বরীর আত্মহত্যার সময় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি তোলপাড় এবং দেবেন্দ্রনাথ তখন বাড়িতেই ছিলেন। মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য বাইরে পাঠানো হয়নি। বাড়ির মধ্যেই করোনার এসে করে গেছেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রের অফিসে লোক পাঠিয়ে সংবাদটি না-ছাপার ব্যবস্থা করেন তিনি। সংবাদটি না-ছাপার জন্য মোট ৫৬ টাকা খরচ হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-কে ক্লাসিক বলতে রাজি হননি। দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এঁরা বড় মাপের ব্যক্তিত্ব হতে পারেন, কিন্তু তাঁরাও রক্তমাংসে গড়া মানুষ। ত্রুটিহীন মানব আর কোথায়? স্বর্গে থাকলেও থাকতে পারে। অবশ্য স্বর্গ বলে সত্যিই যদি কিছু থাকে! |
দেবব্রত নিয়োগী। কলকাতা-২৬ |
|
|
|
|
|