‘ডেড অ্যাসেট’। বা অকেজো সম্পদ। সোনার উপর এই তকমা সেঁটে স্বর্ণশিল্পমহলের সঙ্গে বিতর্কে জড়ালেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ভারতে সোনা চিরাচরিত ভাবেই সম্পদ হিসেবে গণ্য। বাজেটে সোনায় কর বসানোর প্রসঙ্গে সংসদে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্য তাই পুরোপুরি মেনে নিতে নারাজ গয়না ব্যবসায়ীরা।
কর বসানোর প্রতিবাদে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশ জুড়ে স্বর্ণশিল্পে টানা ধর্মঘটের মধ্যেই অর্থমন্ত্রী নতুন করে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহলে। প্রণববাবুর বক্তব্য খণ্ডন করতে যুক্তিজাল বিস্তার করতেও কসুর করেনি দেশের স্বর্ণশিল্পমহল। সোনা ‘ডেড অ্যাসেট’, অর্থাৎ তা নতুন আয়ের পথ সৃষ্টি করে না বলে সংসদে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন গয়না ব্যবসায়ীরা। |
সোমবার মুম্বইয়ে গয়না ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভে পুলিশের লাঠিচার্জ।-রয়টার্স |
তাঁদের দাবি:
• এই শিল্প সারা দেশে প্রায় ২ কোটি কর্মসংস্থান করছে।
• আমদানি করা সোনা দিয়ে তৈরি গয়না রফতানি করে বিদেশি মুদ্রা আয় হয়।
• ২০১১ সালে এই খাতে বিদেশি মুদ্রা আয়ের অঙ্ক ৭০ হাজার কোটি টাকা।
সার্বিক ভাবে সোনাকে ডেড অ্যাসেট বলে চিহ্নিত করায় আপত্তি তুললেও শুধু বিনিয়োগের জন্য যে-সোনা আমদানি করা হয়, তাকে ডেড অ্যাসেট আখ্যা দিতে তাঁদের অবশ্য আপত্তি নেই। পাশাপাশি, ব্যবসায়ীদের দাবি, সোনায় আমদানি শুল্ক এবং ব্র্যান্ড-নাম ছাড়া গয়নার উপর উৎপাদন শুল্ক-সহ আরও যে-সব কর প্রস্তাব বাজেটে করা হয়েছে, তা তুলে নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সংসদে এবং তার বাইরেও বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় সোনাকে ‘ডেড অ্যাসেট’ আখ্যা দিয়েছেন। রবিবার কলকাতায় বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের এক সভায়ও তিনি বলেছেন, “সোনার মতো ডেড অ্যাসেট আমদানি করতে দেশকে বছরে প্রায় ৪৬০০ ডলার বিদেশি মুদ্রা ব্যয় করতে হয়।” প্রতি বছর ভারতে প্রায় ৯০০ টনের মতো সোনা আমদানি করা হয়। ২০১১ সালে করা হয়েছে ৯৬০ টন। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল এবং দেশের গয়না ব্যবসায়ীদের হিসেব মতো আমদানি করা মোট সোনার ২৫ শতাংশ দিয়ে তৈরি হয় রফতানির জন্য প্রস্তুত করা গয়না। ব্যবসায়ীদের মতে, রফতানির উদ্দেশ্যে গয়না তৈরির জন্য যে-সোনা আমদানি করা হয়, তাকে অনুৎপাদক সম্পদ বা ডেড অ্যাসেট বলে আখ্যা দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, ২০১১ সালে গয়না রফতানি করে ভারতের বিদেশি মুদ্রা আয় হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো।
আমদানি করা মোট সোনার ৫৫ শতাংশ ব্যবহৃত হয় দেশের বাজারে বিক্রির জন্য গয়না তৈরি করতে। জেম অ্যান্ড জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অশোক বেঙ্গানি বলেন, “দেশে গয়না শিল্পে ব্যবসায়ী, দোকানের কর্মী এবং গয়না তৈরির কারিগর-সহ প্রায় ২ কোটি মানুষ যুক্ত। আমাদের দেশে সোনা তেমন উৎপন্ন হয় না। তাই প্রধানত আমদানি করা সোনা দিয়েই গয়না তৈরি হয়। কিছু নতুন গয়না তৈরি হয় পুরনো গয়নার সোনা গলিয়ে। যে-সোনা দেশের অত লোকের জীবিকার ব্যবস্থা করছে, তাকে ডেড অ্যাসেট বলে মানতে আমরা নারাজ।”
তবে শুধু বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে যে-সোনা আমদানি করা হয়, তাকে অবশ্য ডেড অ্যাসেট আখ্যা না-দেওয়ার ব্যাপারে যুক্তি দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলেন, ওই সোনার সঙ্গে গয়না শিল্পের কোনও যোগ নেই। আমদানি করা মোট সোনার ২০ শতাংশ দিয়ে ওই লগ্নি চলছে। এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ই টি এফ) বা গোল্ড বন্ড ছেড়ে যে-অর্থ সংগৃহীত হয়, তা দিয়ে সোনা কেনে সংশ্লিষ্ট মিউচুয়াল ফান্ড সংস্থাগুলি।
পাশাপাশি, শুধু বিক্রি করার জন্য ব্যাঙ্কগুলি সোনার কয়েন, বিস্কুট বা বার আমদানি করে। অশোকবাবু বলেন, “ওই সোনা কোনও কর্মসংস্থান করছে না, অথবা তা দিয়ে বিদেশি মুদ্রা আয়ও সম্ভব হচ্ছে না। তা জমা পড়ে থাকে ভল্টে। যেহেতু দেশের কোনও কাজে লাগছে না, তাই শুধু ট্রেডিংয়ের উদ্দেশ্যে আমদানি করা সোনার উপর শুল্ক বাড়ানো অযৌক্তিক নয় বলেই মনে করি। ওই সোনা আমদানি বন্ধের নির্দেশ দিলেও আমাদের আপত্তি নেই।”
বাজেটে গয়না কেনার উপর আয়কর (ট্যাক্স ডিডাকশন অ্যাট সোর্স) কাটার যে প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী রেখেছেন, তা কার্যকর হলে দেশে গয়না শিল্পে কালোবাজারি বেড়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেছেন স্বর্ণশিল্প বাঁচাও কমিটির সভাপতি এবং বিসি সেন জুয়েলার্সের ডিরেক্টর সুবীর সেন। তিনি বলেন, “টিডিএসের ঝামেলা এড়াতে কালোবাজারে গয়না কেনার বহর বেড়ে যাবে বলে আমাদের আশঙ্কা। ফলে সরকারও বিক্রয়কর পাবে না। তা ছাড়া কালোবাজারের গয়নায় ভেজাল বাড়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের স্বর্ণ নিয়ন্ত্রণ আইনের মতো এ বারের বাজেট প্রস্তাবগুলিও দেশের স্বর্ণশিল্পের চূড়ান্ত ক্ষতি করবে বলে আমাদের আশঙ্কা।” |