সরকারি গ্রন্থাগারে কোন কোন সংবাদপত্র রাখা যাবে, তার তালিকা বেঁধে দেওয়ার নির্দেশিকা ঘিরে বিতর্ক আরও ঘনীভূত হল!
ওই নির্দেশিকার জেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলতে যে দিন রাজি হলেন না প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সেই দিনই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করলেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী তথা তৃণমূল সাংসদ শিশির অধিকারী। তাঁর সাফ কথা, সরকারের কথা যারা ছাপবে, তাদের কাগজই রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে মমতার সরকার ‘ভুল’ কিছু করেনি!
সংবাদপত্র সংক্রান্ত সাম্প্রতিক নির্দেশিকা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে শিশিরবাবু রবিবার বলেন, “সরকারের কিছু কথা আছে। সেই কথা যারা ছাপবে, সেই কাগজ সরকার কিনতে বলবে না? আমি সরকার চালাই। আমি বলব না? পয়সা দেবে, সরকার কিছু বলবে না? মাওবাদীদের কাগজ, জমি-চোরদের কাগজ, খুনিদের কাগজ আমি কিনব কি না, সেটা ঠিক করার অধিকার তো আমার আছে!” কাঁথির তৃণমূল সাংসদের আরও বক্তব্য, “কাগজ বা চ্যানেলে বিজ্ঞাপন কিন্তু বন্ধ হয়নি। এটা মনে রাখতে হবে। কেন কী ঘটছে, সব আমরা বুঝতে পারছি। যখন মুখ খোলার দরকার হবে, দল সেইমতো সিদ্ধান্ত নেবে। জেলায়, একেবারে ব্লক স্তরে আমরা তখন ঠিক এর মোকাবিলা করব।” তার মানে তিনি কি মনে করছেন, ওই নির্দেশিকা ঠিক? মাথা নেড়ে শিশিরবাবুর জবাব, “হ্যাঁ! ঠিক!”
বস্তুত, শিশিরবাবুর এ দিনের মন্তব্যে সরকারি ওই সিদ্ধান্তের ‘অভিপ্রায়’ নিয়েই নতুন করে প্রশ্ন উঠল। নির্দেশিকা নিয়ে সর্ব স্তরে বিতর্কের প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী তথা তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী মমতা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তুলনামূলক ভাবে ছোট সংবাদপত্রগুলির পাশে দাঁড়ানোর জন্যই সরকারি গ্রন্থাগারে সেগুলি রাখার কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি তাঁর সরকারের ‘নীতি’র প্রশ্ন। সেই ‘নীতি’ মেনেই কাগজ বাছাই করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্য কোনও ‘অভিসন্ধি’ নেই। তবে একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য ছিল, “মানুষ কোন কাগজ কিনে পড়বে, এখনও সেটা বলিনি! আগামী দিনে বলব!” শিশিরবাবু এ বার তাঁর দলনেত্রীর সেই ঘোষণাকেই আরও এক কদম এগিয়ে নিয়ে গেলেন। সরকারের কথা যারা বলবে, সেই কাগজই কেনা হবে তাঁর এই মন্তব্যের মাধ্যমে গ্রন্থাগার দফতরের নির্দেশিকার ‘নেপথ্য কারণ’ নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল। তা হলে কি ‘নীতি’ নয়, ‘আনুগত্যের পৃষ্ঠপোষকতা’ই এমন সিদ্ধান্তের কারণ?
শুধু সরকারি নির্দেশিকার পাশে দাঁড়ানোই নয়। কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন মেচেদার নবীন সঙ্ঘের মাঠে তৃণমূলের পঞ্চায়েতি-রাজ সম্মেলনে শিশিরবাবু এ দিন সরাসরিই বলেছেন, “খুনি, মাওবাদী ও জমি-ডাকাতদের কাগজ পড়বেন না। যাঁরা সাধারণ মানুষের কথা লেখে না, সরকারের কাজের প্রশংসা করে না, তাঁদের কাগজ পড়বেন না!” তবে নির্দিষ্ট কোনও সংবাদপত্রের নাম করেননি শিশিরবাবু। মঞ্চ থেকে নেমে গাড়িতে ওঠার আগে আনন্দবাজারের প্রতিনিধির প্রশ্নের জবাবে অবশ্য তিনি বলেন, “কাদের কথা বলছি সকলেই জানেন। যারা টাটার হয়ে ওকালতি করেছে, হাওড়া-খড়্গপুর ও হাওড়া-বর্ধমান লাইনে বহু জমি কিনে রেখেছে, যারা জমির ‘সিলিং’ তুলে দেওয়ার জন্য মমতার উপরে চাপ দিচ্ছে, তাদের কথাই বলছি। এরা বড়লোকেদের কাগজ। আগের সরকারের আমলে সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে। এখন বাবুয়ানি দেখাচ্ছে! আমরা তো সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করিনি।” |
|
রবিবার মেচেদার সভায়। |
সরকারের কিছু কথা আছে। সেই কথা যারা ছাপবে, সেই কাগজ সরকার কিনতে বলবে না? পয়সা দেবে, আর সরকার কিছু বলবে না?
শিশির অধিকারী, তৃণমূলের কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী |
|
|
গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রে সরকার ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়ে শিশিরবাবুর সংযোজন, “ওরা (সংবাদমাধ্যমগুলি) আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। প্রয়োজনে সরকারের কাজের খতিয়ান নিয়ে আমরাই গ্রামেগঞ্জে প্রচার চালাব।”
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু অবশ্য মনে করছেন, ‘আত্মবিশ্বাসে’র অভাবই সরকারের এমন সিদ্ধান্তের মূলে। বুদ্ধবাবুর দল সিপিএম ইতিমধ্যেই সরকারি ‘ফতোয়া’র বিরুদ্ধে পথে নেমেছে। তবে বুদ্ধবাবু নিজে সরকারের এই প্রবণতাকে এখনই ‘ফ্যাসিজম’ বলতে নারাজ। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এ দিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ফ্যাসিজম একটা অনেক বড় ব্যাপার। বুর্জোয়া, প্রতিক্রিয়াশীলদের জঘন্যতম একটা অবস্থা সেটা। এখানে ঠিক সেটা নয়।” বুদ্ধবাবুর মতে, “অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। শুধু বিরোধী বামফ্রন্ট নয়। বিরোধী ব্যক্তি, বিরোধী পত্রিকা, বিরোধী চ্যানেল কাউকেই সহ্য করতে পারছেন না! এটা অন্য জায়গা থেকে আসছে। আত্মবিশ্বাসের অভাব হলে এটা হয়।” বুদ্ধবাবুর ওই সাক্ষাৎকার অবশ্য শিশিরবাবুর এ দিনের মন্তব্যের আগেই রেকর্ড করা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলা যায় কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই এ রাজ্যে বিতর্ক হয়েছে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে ‘পরিবর্তনপন্থী’ বলে পরিচিত বিদ্বজ্জন মহাশ্বেতা দেবী মুখ্যমন্ত্রী মমতার একটি সিদ্ধান্তকে ‘ফ্যাসিবাদী’ ছাড়া কী বলা যায়, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এপিডিআরের সভা বাতিল করা নিয়ে বিতর্কের মাঝে মহাশ্বেতা দেবীর ওই মন্তব্য নতুন বিতর্ক তৈরি করেছিল। মমতার প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বুদ্ধবাবু কিন্তু এ দিন বুঝিয়ে দিলেন, তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘অসহিষ্ণুতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও ‘ফ্যাসিবাদ’ আখ্যা দিতে তিনি এখনও রাজি নন।
ঘটনাচক্রে, সংবাদপত্র সংক্রান্ত ওই ‘ফতোয়া’ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছে এ দিনই চিঠি পাঠিয়েছেন সরকারের জোট শরিক, প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। সংবাদপত্রের ‘আমরা-ওরা’ বিভেদ মেটানোর অনুরোধ করে প্রদীপবাবুর চিঠিতে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট কয়েকটি কাগজ গ্রন্থাগারে রাখার ‘অগণতান্ত্রিক’ নির্দেশিকা অবিলম্বে প্রত্যাহার করলে সরকারের কোনও ‘সম্মানহানি’ হবে না।
রাজ্য সরকারের গ্রন্থাগার দফতরের নির্দেশিকার বিরোধিতায় আগেই সরব হয়েছিল প্রদেশ কংগ্রেস ও তাদের পরিষদীয় দল। সংবাদমাধ্যমের উপরে কোনও রকম ‘হস্তক্ষেপ’ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বও যে সমর্থন করেন না, তা শনিবারই এক অনুষ্ঠানে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা তথা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার পরের দিনই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পাঠানো চিঠিতে জেলার গ্রামাঞ্চল ও ব্লক স্তরে বিভিন্ন প্রকাশনায় সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধের বিরুদ্ধেও ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘গ্রামাঞ্চলে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধের নির্দেশিকার জেরে ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকাগুলির বিকাশ ব্যাহত হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় এমন হস্তক্ষেপ সমর্থন করতে পারছি না’। সাধারণ ধর্মঘটের দিন গাঙ্গুলিবাগানে এবং গত সপ্তাহে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে সাংবাদিকদের উপর হামলারও নিন্দা করা হয়েছে চিঠিতে। |