ভাগীরথীর মূল স্রোত রেখে গেছে দীর্ঘ দশ কিলোমিটারের মতন এক অশ্বক্ষুরাকৃতি জলাভূমি। আঞ্চলিক একটা নামও আছে, ‘ছাড়ি গঙ্গা’। পূর্বস্থলীর দু’নম্বর ব্লকের চুপি পাখিরালয়। প্রায় এক দশক ধরে এখানেই তরুণ প্রজন্মের সঞ্জয় সিংহ পরিযায়ী ও স্থানীয় পাখিদের বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানালেন।
‘নিজের ঠাঁই নেই থাকার
শঙ্করাকে ডাকে’।
এই প্রবাদ চালচুলোহীন শিবকে নিয়ে। যার অনেকটাই প্রযোজ্য সঞ্জয় সিংহের ক্ষেত্রেও। ত্রিশ ছুঁতে চলেছেন এই যুবক। লেখাপড়া সামান্য। কৈশোরে ভাগীরথী বাস্তুচ্যুত করেছে সঞ্জয়দের পরিবারকে। ফলে বেশ কিছু পরিবারের সঙ্গে সঞ্জয়রাও বাস্তু হারিয়ে রাস্তার ওপরে ত্রিপলের ছাউনিতে আশ্রয় নেয়। জলায় মাছ ধরে সঞ্জয়দের জীবিকা। কিন্তু এত দারিদ্রে হঠাৎ পরিবেশ, পক্ষিপ্রেম জেগে উঠল কেমন করে?
“অনেক দিন ধরেই দেখে আসছি পাখি আসে। পরিযায়ী পাখিরা এসে ডিম পাড়ে শীতে। বাচ্চা বড় করে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। আবার এই জলাভূমির কিছু স্থায়ী পাখিও আছে। স্থানীয় মানুষেরা এই সব পাখিদের মাংসের লোভে মেরে খায়। প্রথমে গুলতি-বন্দুক ছিল। তার পরে এল বড়শি। আমরা বাধা দিলাম। পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে নানা জায়গায় জানালাম। ওরা, পাখিরাও যে আমাদের প্রতিবেশী, তা ভেবেই এই কাজ শুরু।”
প্রাথমিক অনুভূতির কথা জানালেন সঞ্জয়। নিমন্ত্রণও করলেন ৯ জানুয়ারি চুপিচরের ‘পক্ষিদিবসে’ আসার জন্য।
সমস্যা হয়েছে অন্যখানে। পূর্বস্থলীর চুপিচর ও কাষ্ঠশালীতে গড়ে উঠেছে ‘আনন্দনগর’ পর্যটন কেন্দ্র। ভাল কথা। এই উদ্যোগ বনবিভাগ ও জেলা পরিষদের। সেও ভাল কথা। কিন্তু যে বিষয়টি একেবারেই ভাল নয় তা হল, বেশির ভাগ পর্যটকই বিষয়টিকে পিকনিক স্পট, সঙ্গে একদিনের ‘ধামাকা’ বলে ভাবেন। চড়া স্বরে মাইক, পিকনিকের রান্না, খাওয়াদাওয়া, হইচইসব মিলিয়ে সফল বিনোদনকেন্দ্র হয়ে উঠলেও, অনেক পর্যটকই সচেতন নন স্থানীয় পরিবেশ নিয়ে। মাঝে পাখিদের আসা-যাওয়ার সঙ্কট বাড়ে। বিশেষত পরিযায়ী পাখিদের। অথচ জানা গেল সুদূর মধ্য চিন, সাইবেরিয়া ও লাদাখ থেকে পরিযায়ী পাখি আসে।
সঞ্জয়ের কথায়, “অনেক পাখি চিনছি। অনেকের নাম জানি না। তাই নিয়ে বই, পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করে পড়াশোনা করছি। সাত-আট বছর ধরে এখানে আসা মানুষ-অতিথিদের বোঝাই। অতিথি-পাখিদের বিরক্ত না-করতে, পরিবেশ বাঁচাতে অনুরোধ করি। এতে ফল মিলেছে। শীতের সময় বেড়াতে-আসা মানুষদের পাখি চেনাই। অবশ্য আমি যতটুকু চিনি। এর ফলে গত শীতে পাখির সংখ্যা বেড়েছিল। এই শীতে আরও বাড়বে।”
ঘটনাটি অবশ্যই পরিবেশ ও পাখিদের পক্ষে মঙ্গলজনক।
নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র জানালেন, “কাষ্ঠশালীর তরুণেরা যে উদ্যোগ নিয়েছে তা মূল্যবান। এ রকম জেলা-ব্লক স্তরে স্থানীয় মানুষ সচেতন হলে একটা পরিপূর্ণ পরিবেশ-সচেতনতা গড়ে উঠবে। যা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।”
আপাতত এখানকার জলাভূমিতে দেখা পাখিগুলির প্রতি বেশ সতর্ক প্রহরী এই তরুণেরা। সরাল আসে হাজার পাঁচেক। পরিযায়ী ডাউখোল (আঞ্চলিক নাম কুট) আসে। কম দেখা যায়, কিন্তু দেখতে পাওয়া যায়। পরিযায়ী পাখি পারগানি (চৈতা, মাথানীল)। সতীনাথ ভাদুড়ির বিখ্যাত গল্পের ‘চখাচখি’ও দেখা যায় এখানে। এ ছাড়া প্রচুর আছে আঞ্চলিক পাখি জল পিপি, গাংচিল, বালিহাঁস। এগুলিকে মানুষের মমতা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে, ভ্রামণিক মানুষদের জীবনে একবেলায় যতটুকু আনন্দ পাওয়া সম্ভব, তার আয়োজনটুকু করতে পারলেই সকলের উপকার। আর এই কাজের প্রসারে ভ্রমণকারীরা যদি সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য করেন এই তরুণদের, তা হলে তো মানুষ-পাখি-পরিবেশ সবই বেঁচেবর্তে থাকতে পারে স্বচ্ছন্দে! |