সৌজন্য সংখ্যাও রাখা যাবে না
সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুদ্ধ বিধানসভাতেও
বার সংবাদমাধ্যমের একাংশের বিরুদ্ধে তাঁর ‘যুদ্ধ’ বিধানসভার অন্দরে নিয়ে এলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাসপাতালের মতো ক্ষেত্র বিশেষে সংবাদমাধ্যম যে ‘গায়ের জোরে’ ঢুকে ‘গুন্ডামি’ করে, এ দিন এমন মন্তব্যও করেন মুখ্যমন্ত্রী। একই দিনে গ্রন্থাগার মন্ত্রী করিম চৌধুরী জানিয়ে দেন, যে সব সংবাদপত্র সরকারি তালিকায় নেই, সেগুলি কেনা তো দূরের কথা, তার সৌজন্য সংখ্যাও গ্রন্থাগারে রাখা যাবে না। বিরোধীরা তো বটেই, সরকারের জোট শরিক কংগ্রেসও এই অবস্থানের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। প্রতিবাদে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে পথেও নেমেছে কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন এ-ও জানিয়েছেন, তিনি সংবাদমাধ্যমের ‘বিরোধী’ নন।
বিরোধী নেত্রী বা কেন্দ্রে মন্ত্রী থাকার সময় অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেই মমতার ‘সুসম্পর্ক’ ছিল। কিন্তু তিনি রাজ্যে ক্ষমতায় আসার দশমাসের মধ্যে সেই সম্পর্কে যথেষ্ট ‘অবনতি’ ঘটেছে। যার কারণ মূলত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ‘সমালোচনা’ বলেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের অভিমত। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও প্রকাশ্যে একাধিক বার জানিয়েছেন, ‘চক্রান্ত করে কুৎসা রটানো হচ্ছে’।
গত কয়েক দিন ধরে মুখ্যমন্ত্রীর লড়াই চলছে মূলত ‘প্রিন্ট মিডিয়া’ বা খবরের কাগজের বিরুদ্ধে। কিন্তু এদিন বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর তোপের মুখে পড়েছিল দৃশ্যমাধ্যম (নিউজ চ্যানেল)। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল পুনর্গঠন সংক্রান্ত একটি বিল নিয়ে বিতর্কের সময় সভায় উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রীকে লক্ষ করে বিরোধীপক্ষের আনিসুর রহমান বলেন, “হাসপাতালে সংবাদমাধ্যম ঢুকতে পারে না! কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বাঙুর হাসপাতালে তিনি দলবল, সংবাদমাধ্যম নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন। এটা কি বিলে রয়েছে?”
সঙ্গে সঙ্গেই হট্টগোল শুরু হয়। হল্লা শুরু করে সরকার পক্ষ। নিজের আসনে বসে মুখ্যমন্ত্রীও মাথা নাড়তে নাড়তে মাইক্রোফোনের সবুজ আলো জ্বালিয়ে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আনিসুরের বক্তব্যের পর বিবৃতি দিতে গিয়ে বাঙুর-প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি তো সারপ্রাইজ ভিজিটে গিয়েছিলাম! কেউ যাতে জানতে না পারে, সেটাই চাই। কিন্তু কোনওভাবে জেনে সংবাদমাধ্যম চলে গেলে কী করব!”
বিরোধী পক্ষ থেকে প্রশ্ন ভেসে আসে, “কারা খবর দেন?” মুখ্যমন্ত্রী পাল্টা বলেন, “আপনারাই (বিরোধী) বলে দেন!”
বিরোধীরা সেই বক্তব্যের প্রতিবাদ করলে সরকার পক্ষ থেকেও পাল্টা দোষারোপ-কটাক্ষ চলতে থাকে। তুমুল বিশৃঙ্খলার মধ্যে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় দু’পক্ষকেই শান্ত হওয়ার আবেদন জানান। মুখ্যমন্ত্রীও হাত নেড়ে সরকার পক্ষকে শান্ত হতে বলেন। তার পর বলেন, “গায়ের জোরে সংবাদমাধ্যম হাসপাতালে ঢুকে যায়! দেখে দুঃখ পাই। আমি সংবাদমাধ্যমের বিরোধী নই। প্রতিযোগিতার জন্য ওরা হয়ত এমন করে। দেখেছি, কোনও ঘটনা ঘটলে ক্যামেরাম্যান হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ক্যামেরা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে ঢুকে যাচ্ছে। ওদের ধাক্কায় মুমূর্ষু রোগীর স্যালাইনের বোতল পড়ে ভেঙে গেল! অক্সিজেন মাস্ক খুলে গেল! রক্তের বোতল পড়ে গেল!”
সরকারে সংবাদপত্র সংক্রান্ত সার্কুলারের প্রতিবাদে
রায়গঞ্জে যুব কংগ্রেসের মিছিল। ছবি: তরুণ দেবনাথ
মুখ্যমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “টিআরপি বাড়ানোর জন্য ক্যামেরা নিয়ে সংবাদমাধ্যম হাসপাতালে ঢুকে পড়ে। হাসপাতালে ঢোকার অনুমতি নেই। ডাক্তাররা সামলাবেন হাসপাতাল। হাসপাতাল গুণ্ডামি করার জায়গা নয়!” ব্যক্তিগত ভাবেও অনেককে সংবাদমাধ্যম তাদের ‘মর্জিমাফিক’ চলতে বাধ্য করে বলে অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর। তাঁর বক্তব্য, “প্রত্যেকের ভৌগোলিক সীমারেখা রয়েছে। আমারও রয়েছে।”
বস্তুত, রাজ্য বিধানসভায় চাপানউতোরের মধ্যেই সরকারি গ্রন্থাগারে সংবাদপত্রের ‘আমরা-ওরা’ নিয়ে বিতর্ক জারি রয়েছে। এদিন কংগ্রেস পরিষদীয় দলের বৈঠকে সংবাদপত্র বিতর্ক নিয়ে আলোচনা হয়। পরে পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব বলেন, “সরকার ছোট ও নতুন সংবাদপত্রকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু অন্য সংবাদপত্রকে অগ্রাহ্য করবে কেন? গ্রন্থাগারে যে কাগজগুলো রাখার কথা সরকার বলেছে, সেগুলিই একমাত্র মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটায় এটা আমরা সমর্থন করতে পারছি না। সরকারি নির্দেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ করছি।”
গ্রন্থাগার মন্ত্রী করিম চৌধুরী অবশ্য এদিন জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ বা ‘বর্তমান’ পত্রিকার ‘সৌজন্য সংখ্যা’ও সরকারি বা সরকার-অনুমোদিত গ্রন্থাগারে রাখা যাবে না। করিমের কথায়, “ব্যাপারটা নিয়ে আমায় আলোচনা করতে হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা নিয়ম, সেটাই থাকছে।” এ দিন করিমের জেলা উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জেই অবশ্য সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মিছিল করেছে কংগ্রেস। ব্যারাকপুর তালপুকুরে বিটি রোডে কংগ্রেস তাঁর কুশপুতুল দাহ করেছে। উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে প্রতিবাদ-মিছিল করেছে এসএফআই। ত্রিপুরা সিপিএম ওই ঘটনাকে ‘অগণতান্ত্রিক ও সংবিধান-পরিপন্থী’ বলেছে।
এর মধ্যেই রাজ্যের প্রাক্তন গ্রন্থাগার মন্ত্রী তপন রায় বলেছেন, “বাম সরকারের আমলেও আনন্দবাজার পত্রিকা সরকারের কাজের ব্যাপক সমালোচনা করেছে। কিন্তু তখনও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। প্রতিটি গ্রন্থাগারের পরিচালন সমিতি রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ১৬ নম্বর ধারায় বলা রয়েছে, পাঠক-পাঠিকাদের পছন্দমতো সংবাদপত্র রাখতে হবে। গ্রন্থাগারগুলি কোন কাগজ রাখবে, তা সরকার ঠিক করে দিতে পারে না।”
ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবারই ‘বাছাই’ কয়েকটি টিভি চ্যানেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রী প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, “মানুষ কোন কাগজ কিনে পড়বে, সেটা তো আমরা এখনও বলিনি! আগামী দিনে বলব। কারণ বিষয়টা আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্তের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে!”
সংবাদপত্র নিয়ে ‘ফতোয়া’ জারির প্রতিবাদে বিক্ষোভ বিশ্বভারতীর
ছাত্র পরিষদের সদস্যদের। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের সূত্র ধরে সরকারি দফতরগুলির একাংশে ইতিমধ্যেই ওই ‘সেন্সর’ চালু করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এদিনই সকালে মধ্য কলকাতার একটি থানায় কর্তব্যরত কনস্টেবল সংবাদপত্র বিক্রেতাকে নিয়মিত তিনটি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ও একটি করে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর বদলে তিনটি করে ‘সংবাদ প্রতিদিন’ ও একটি করে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ দেওয়ার নির্দেশ দেন। থানায় সংবাদপত্র সরবরাহকারী ‘ভেন্ডর’ অলোক কুন্ডু ওই ঘটনা জানিয়ে বলেন, “আমি গত তিন, সাড়ে-তিনবছর ধরে ওই থানায় আনন্দবাজার-টেলিগ্রাফই দিচ্ছি। এ দিন ওই নির্দেশ শুনে বিস্মিত হই। আমায় জানানো হয়, বড়বাবুর নির্দেশেই ওই কথা বলা হয় রাজ্যের গ্রন্থাগারগুলিতে কোন সংবাদপত্র রাখা যাবে তা নিয়ে সরকারি বিজ্ঞপ্তির প্রতিবাদে জনস্বার্থ মামলার শুনানি পিছিয়ে গিয়েছে। আবেদনকারী বাসবী রায়চৌধুরীর পক্ষে আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় শুক্রবার মামলাটি শোনার জন্য প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের কাছে আবেদন জানান। প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল ও বিচারপতি সম্বুদ্ধ চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ সোমবার ওই মামলাটি উল্লেখ করার নির্দেশ দেন। তারপর হাইকোর্ট মামলাটির শুনানি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। বৃহস্পতিবার মামলাটি দায়ের করেন বাসবীদেবী। আবেদনে রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তিটি দেশের ‘সংবিধান-বিরোধী’ বলে দাবি করা হয়েছিল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.