|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
পাঁচশো বছরে ‘ভারত’ নির্মাণ |
ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী |
ম্যাপিং ইন্ডিয়া, মানসী লাহিড়ি। নিয়োগী বুকস, ৪৫০০.০০ |
|
‘কোথা সে বিরাজে
ব্রহ্মাবর্তে কুরুক্ষেত্র; কোথা কন্খল,
যেথা সেই জহ্নুকন্যা যৌবনচঞ্চল...’
(মেঘদূত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
মেঘদূত কাব্যে নির্বাসিত যক্ষ যে ভাবে মেঘকে তাঁর বিরহিণী প্রিয়ার কাছে যাওয়ার পথনির্দেশ দিয়েছিল, তা পড়লে কি মনে হয় কালিদাস কখনও কোনও মানচিত্র দেখেননি? শুধু ভূগোলের জ্ঞান নয়, পাখির চোখে বিস্তীর্ণ অঞ্চল না দেখতে পারলে এ ভাবে লেখা কঠিন, তা সে কবির কল্পনা যত সুদূরপ্রসারীই হোক না কেন। আর মানচিত্র তো পাখির চোখেই দেশ দেখে!
এটা সত্যি যে প্রাচীন ভারতে আঁকা কোনও মানচিত্র তো পাওয়া যায়নি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় যে দেশ এতটা উন্নতি করেছিল, মানচিত্র কেন আঁকেনি তারা? অথচ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকেই পৃথিবীর মাপজোক অনেকটা নিখুঁত ভাবে করতে পেরেছিলেন আর্যভট্ট, পৃথিবী যে গোলাকার এ নিয়েও কোনও সংশয় ছিল না। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ চিহ্নিত করা, উত্তর দিক নির্দিষ্ট করা, এ সবও নাকি সম্ভব হয়েছিল। ভৌগোলিক সমীক্ষার নানা যন্ত্রপাতির উল্লেখও পাওয়া যায়। গুপ্তযুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজবংশের ভূমিদান বা বিক্রয় সংক্রান্ত যে সব তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছে, তাতে ভূমির অবস্থান খুব নির্দিষ্ট ভাবেই চিহ্নিত। ভূমি সমীক্ষা এবং মানচিত্র তৈরির নিয়মিত ব্যবস্থা না থাকলে এটা কী ভাবে সম্ভব? রাজ্যের সীমা চিহ্নিত করা, কর আদায় এই সব কিছুর সঙ্গেও তো মানচিত্র জড়িত।
মানসী লাহিড়ি অবশ্য তাঁর বইয়ে এই বিতর্কে জড়াননি। শুরুতেই সোজাসুজি বলেছেন, অষ্টম শতকে পশ্চিমে দ্বারকা থেকে পুবে পুরী, আর উত্তরে বদরীনাথ থেকে দক্ষিণে রামেশ্বরম, ‘ভারত’-এর চার প্রান্তকে এই চার ধাম দিয়ে চিহ্নিত করেছিলেন শঙ্করাচার্য, কিন্তু মানচিত্রে তার কোনও প্রতিফলন আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি। মানসী ধরেছেন গত পাঁচশো বছরে মানচিত্রে ‘ভারত’ নির্মাণের ইতিবৃত্তকে।
১৪৯৮-এ ভাস্কো দা গামা যখন উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতে পৌঁছলেন, মানচিত্র নির্মাণে ইয়োরোপ তখন যথেষ্ট উন্নত। সমুদ্রপথে ব্যবসা করতে নেমে পড়েছিল যে সব দেশ, তারাই প্রথম ভারতের উপকূলবর্তী এলাকার মানচিত্র এঁকেছিল। তারপর আস্তে আস্তে উপকূল পেরিয়ে দেশের ভিতরে পা ফেলা। বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে...
গোড়ার দিকের মানচিত্রকারদের অধিকাংশই অবশ্য ভারতে পা দেননি। নাবিক আর পর্যটকদের গল্প থেকে তাঁরা তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, এমন অনেক নদী-পাহাড়-শহর মানচিত্রে ঢুকে পড়েছে বাস্তবে যার কোনও অস্তিত্বই নেই। শুধু ঢুকে পড়েনি, পরবর্তী কয়েক দশক ধরে তা অন্যান্য মানচিত্রে স্থায়ী জায়গাও করে নিয়েছে! তবে তথ্যে ঘাটতি থাকলেও প্রথম যুগের এই সব মানচিত্র চমৎকার অলংকরণের জন্য দৃষ্টিনন্দন, দেশবিদেশের সংগ্রাহকরা এ সব খুঁজে ফেরেন।
পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজরাই প্রথম ইয়োরোপ থেকে এ দেশে বাণিজ্য শুরু করে। আস্তে আস্তে এগিয়ে এল ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড। প্রতিদ্বন্দ্বিতা যত তীব্র হতে লাগল, উপকূলের একের পর এক নিখুঁত মানচিত্র তৈরি হতে লাগল। প্রত্যেকেই নিজের সংগ্রহ করা তথ্য গোপন রাখত। পর্তুগিজ সরকারের কর্মচারী জোয়াও দে বারোস ঘুরেছিলেন বিস্তর, আর ষোড়শ শতকে এশিয়ায় পর্তুগিজ সমুদ্রবাণিজ্যের বিস্তার নিয়ে লিখেওছিলেন চার খণ্ড বই। তাতে চট্টগ্রামের মতো আঞ্চলিক বাণিজ্যকেন্দ্র নিয়ে যেমন প্রচুর তথ্য আছে, তেমনই আছে বাংলার একটি মানচিত্র (১৬১৫-য় মুদ্রিত)। বাংলা যে গঙ্গার একটি বদ্বীপ, উত্তরে পর্বতশ্রেণি আর দক্ষিণে সমুদ্র পরিবেষ্টিত, দক্ষিণবাহিনী অনেকগুলি নদীবিধৌত তা এই মানচিত্রেই স্পষ্ট দেখা গেল। ১৬৬০ নাগাদ ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ম্যাথিয়াস ফান ডেন ব্রোক বাংলার যে মানচিত্রটি তৈরি করান, তাতে নাবিকদের উদ্দেশে বলা আছে, গাঙ্গেয় বদ্বীপের প্রবেশপথটি বিপজ্জনক। হুগলি নদীর ধারে বিভিন্ন ইয়োরোপীয় কোম্পানির বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি তখন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, মানচিত্রে তাদের অবস্থান রীতিমতো পতাকা দিয়ে দেখানো আছে। নানা ত্রুটি সত্ত্বেও ফান ডেন ব্রোকের মানচিত্রকে অনেক দিন পর্যন্ত বাংলার ঠিকঠাক মানচিত্র বলে ধরা হত।
মোগল ভারতের প্রথম ব্রিটিশ মানচিত্র আঁকেন উইলিয়াম বাফিন, সেটি ছাপা হয় ১৬১৯-এ। জাহাঙ্গিরের সভায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দূত সার টমাস রো-র সংগৃহীত তথ্য এখানে কাজে লেগেছিল। এই মানচিত্রে হরিদ্বারের কাছে গঙ্গায় একটি গরুর মুখ দেখানো আছে, সম্ভবত এই গল্প শুনে যে গঙ্গার উৎপত্তি ‘গোমুখ’ থেকে। মোগল সুবাগুলি এই মানচিত্রে প্রদর্শিত, সব ঠিক জায়গায় নয়। তবে পরের একশো বছর বাফিনের মানচিত্র ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
অজানা দেশের আসল ছবিটা তুলে ধরা, ব্যবসা-বাণিজ্য আর প্রতিদ্বন্দ্বী বা দেশীয় রাজাদের পদানত করার আকাঙ্ক্ষা থেকে সতেরো-আঠারো শতক জুড়ে একের পর এক মানচিত্র তৈরি হতে থাকে, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হতে থাকে মানচিত্রও। ‘আর্লি প্ল্যান্স অ্যান্ড স্কেচেস’ অধ্যায়ে মানসী দেখিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠা অথবা রণকৌশলগত গুরুত্বের জন্য কালিকট, গোয়া, সুরাট, হুগলি, মাদুরাই, কাশিমবাজার, বজবজ, ট্রাঙ্কুবার, শ্রীরামপুর, মসুলিপত্তনম, পন্ডিচেরি, মাহে-র নানা ধরনের মানচিত্র আঁকা হয়েছিল। আবার বিশেষ করে যুদ্ধবিগ্রহের প্রয়োজনেই আঁকতে হয়েছিল বিভিন্ন দুর্গ ও শহরের মানচিত্র। আক্রমণকারী ও প্রতিরোধকারী উভয় বাহিনীরই জানা দরকার রক্ষাব্যূহ কোথায়, খাবার জলের উৎস কী, দুর্গের দুর্বলতা কোথায়, সরবরাহ ব্যবস্থাই বা কী। এমন মানচিত্রে সব সময় নির্দিষ্ট পদ্ধতি মানা হত না, যে দিক থেকে আগে আক্রমণ হয়েছে বা হওয়ার আশঙ্কা আছে, সে দিক থেকেই আঁকা হত। ‘ওল্ড সিটিজ অ্যান্ড ফোর্টস’ অধ্যায়ে আছে হায়দর আলি-টিপু সুলতানের সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য বিখ্যাত মাঙ্গালোর, ধারওয়ার, শ্রীরঙ্গপত্তম; কলিন ম্যাকেঞ্জির সমীক্ষায় বিজয়নগর, জেমস প্রিন্সেপের বেনারস, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সূচনাভূমি কলকাতা ইত্যাদি।
১৭৬৪-তে ভারতে পা দিলেন জেমস রেনেল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই সার্ভেয়ার জেনারেলের হাতেই শুরু হল বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষা আর সেই অনুযায়ী মানচিত্র নির্মাণ। ব্যবসা করতে গেলে জানতে হবে কোথায় কী কাঁচামাল পাওয়া যায়, কী ভাবে সহজে তা নিয়ে আসা যায় নিকটতম বাণিজ্যকেন্দ্রে। দীর্ঘ সমীক্ষার পর ১৭৭৯ আর ১৭৮১-তে প্রকাশিত হল তাঁর বিখ্যাত বেঙ্গল অ্যাটলাস। উনিশ শতকের গোড়ায় উইলিয়াম ল্যাম্বটন শুরু করলেন গ্রেট ট্রিগনমেট্রিক্যাল সার্ভে, যা শেষ হয় ১৮৭০-এ। ল্যাম্বটনের পর এর দায়িত্বে ছিলেন জর্জ এভারেস্ট। ট্রিগনমেট্রিক সার্ভের ফাঁকফোকর ভরাতে শুরু হয় টোপোগ্রাফিক সার্ভে, দেশের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গাই চলে এল এর আওতায়।
পাঁচশো বছরের মানচিত্র নির্মাণের এই ইতিবৃত্তে মানসী আরও খুঁটিনাটি যোগ করেছেন। আছে বিশেষ বিশেষ যুদ্ধ এবং ভূখণ্ড অধিকারের বিশেষ মানচিত্র, হিমালয় অঞ্চল সমীক্ষার বৃত্তান্ত, আর সিপাহি বিদ্রোহের নানা মানচিত্র। তাঁর প্রশ্ন, যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষ ব্রিটিশ ভারতে অঙ্গাঙ্গি ছিল, তা হলে দুর্ভিক্ষের মানচিত্র এত কম কেন?
বড় আকারের তিনশতাধিক পাতার বইটি অজস্র দুর্লভ মানচিত্রের রঙিন প্রতিলিপিতে ঠাসা। অধ্যায়-বিন্যাস আর একটু সরল হলে মানচিত্র নির্মাণে অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বুঝতে সুবিধা হত, এড়ানো যেত কিছু পুনরাবৃত্তিও। |
|
|
|
|
|