|
|
|
|
পরিবেশের জটে ফের আটকে পস্কো সেই তিমিরেই |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
মাত্র চার দিন আগে সোলে এক পার্শ্ব বৈঠকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি মিউং বাককে ওড়িশার পস্কো প্রকল্প নিয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। বলেছিলেন, প্রকল্প হবে, তার কাজও এগোচ্ছে। আর আজ সেই পস্কোরই পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়ে ৫৪ হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্পকে নতুন অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিল জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনাল।
পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা, স্থানীয় বাসিন্দাদের ‘জমি কাড়ার’ চেষ্টা, অরণ্যের অধিকার আইন লঙ্ঘনের মতো অভিযোগ ঘিরে লাগাতার বিতর্ক-আন্দোলনে গোড়া থেকেই জেরবার পস্কো কর্তৃপক্ষ এবং ওড়িশা সরকার। উপরন্তু, পস্কোর জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে রাহুল গাঁধীর মতো কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা এক সময়ে যেমন আপত্তি জানিয়েছেন, তেমনই কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকার সময়ে জয়রাম রমেশও প্রকল্পকে ছাড়পত্র দিতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত যদিও রমেশেরই আমলে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি পরিবেশ-ছাড়পত্র পায় পস্কো প্রকল্প। কিন্তু আজ গ্রিন ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি সি ভি রামুলু এবং বিচারপতি দেবেন্দ্রকুমার অগ্রবাল বলেছেন, পরিবেশ মন্ত্রক ওই ছাড়পত্রের নতুন করে পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন না করা পর্যন্ত তা স্থগিত থাকবে। সেই সঙ্গে পস্কো কর্তৃপক্ষের জন্য নির্দিষ্ট শর্তাবলি জারি করতেও মন্ত্রককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রফুল্ল সমন্ত্রে নামে জনৈক পরিবেশকর্মীর আবেদনের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের বক্তব্য, পরিবেশের উপর পস্কো প্রকল্পের সার্বিক প্রভাব সংক্রান্ত পর্যালোচনা রিপোর্টটি (ইআইএ) অসম্পূর্ণ। ওড়িশা সরকার এবং পস্কো কর্তৃপক্ষের মধ্যে যে ‘মউ’ সই হয়েছিল, তাতে বছরে ১ কোটি ২০ লক্ষ টন ইস্পাত উৎপাদনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পর্যালোচনা রিপোর্টটি তৈরি হয়েছে ৪০ লক্ষ টন ইস্পাত উৎপাদনের নিরিখে, যা শুধুমাত্র প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে উৎপাদিত হওয়ার কথা। ট্রাইব্যুনালের তাই নির্দেশ, ‘গোড়া থেকে মোট উৎপাদনক্ষমতার নিরিখে ওই রিপোর্ট তৈরি করতে হবে।’ পস্কো প্রকল্পকে পরিবেশ-ছাড়পত্র দেওয়ার সময়ে যে পর্যালোচনা কমিটি গঠিত হয়েছিল, তার চেয়ারপার্সন হিসেবে মীনা গুপ্তর নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, ‘আইনের চোখে গোটা পদ্ধতিটাই ভ্রান্ত।’
|
পস্কো-বৃত্তান্ত |
জুন, ২০০৫: জগৎসিংহপুরে ৪০০৪ একর জমিতে
(৩ হাজার একরই বনভূমি) ইস্পাত প্রকল্পের
জন্য পস্কো-ওড়িশা মউ |
সেপ্টেম্বর, ২০০৫: প্রকল্পের
বিরোধিতায় প্রতিরোধ
সংগ্রাম সমিতি গঠন |
ডিসেম্বর, ২০০৬ : অরণ্যের অধিকার আইন পাশ,
যাতে
বলা হল, বনভূমিতে তিন প্রজন্মের বাসিন্দাদের
নির্দিষ্ট
কিছু অধিকার আছে |
জুন, ২০০৭: তিন হাজার একর বনভূমিকে
অন্য
কাজে লাগাতে পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে
ছাড়পত্রের
আর্জি ওড়িশার |
অগস্ট, ২০০৯: ছাড়পত্রের আর্জির সঙ্গে
গ্রামসভার লিখিত অনুমোদন
চাইল পরিবেশ মন্ত্রক |
ডিসেম্বর, ২০০৯: নিজের বিজ্ঞপ্তি এবং
অরণ্যের অধিকার আইন লঙ্ঘন
করেই ছাড়পত্র পরিবেশ মন্ত্রকের |
জুলাই, ২০১০:
ত্রাণ, পুনর্বাসন এবং বনভূমি
হস্তান্তরের বিষয় খতিয়ে দেখতে প্রাক্তন পরিবেশসচিব
মীনা গুপ্তের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের
বিশেষ কমিটি,
পরের মাসেই কাজ বন্ধের নির্দেশ |
মে, ২০১১: বন্ধের নির্দেশ
তুলে
পরিবেশ মন্ত্রকের
চূড়ান্ত ছাড়পত্র |
মার্চ, ২০১২: পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্রে স্থগিতাদেশ জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনালের |
|
স্বাভাবিক ভাবেই বড় ধরনের অস্বস্তিতে মনমোহন সরকার। ওড়িশার জগৎসিংহপুরে ওই প্রস্তাবিত প্রকল্পে পস্কো যে পরিমাণ বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে, এ দেশে কোনও প্রকল্পে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের নিরিখে তা একক বৃহত্তম (৫৪ হাজার কোটি টাকা)। তাই মনমোহন সরকারের মর্যাদার বিষয়টিও এর সঙ্গে জড়িত। শিল্প মহল ও সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, ট্রাইব্যুনালের আজকের সিদ্ধান্তের পর দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের বাতাবরণ নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল। এমনিতেই আর্থিক মন্দা চলছে। তার ওপর নীতি নির্ধারণে সরকারের কার্যত এখন পঙ্গু দশা। নতুন জমি আইন পাশ না হওয়ায় শিল্প স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণও থমকে। আবার খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি থেকে শুরু করে সংস্কারের বিষয়আশয়ও পিছনের আসন নিয়েছে। সেই নেতিবাচক পরিস্থিতিতে আজ আরও একটি মাত্রা জুড়ল বলেই মনে করা হচ্ছে।
ওড়িশা সরকারের সঙ্গে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ইস্পাত উৎপাদন সংস্থা পস্কোর চুক্তি হয়েছিল ২০০৫ সালে। উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১-এ। কিন্তু পরিবেশ-ছাড়পত্র নিয়ে টানাপোড়েনে এখনও পর্যন্ত প্রকল্প এলাকায় একটি ইটও গাঁথা হয়নি। যার অর্থ, ইতিমধ্যেই সাত বছর পিছিয়ে রয়েছে প্রকল্পটি। ওড়িশায় মিত্তলদের ইস্পাত প্রকল্প বা বেদান্তর প্রস্তাবিত কারখানারও কার্যত এখন একই দশা। শিল্পমহলের মতে, এ ধরনের দীর্ঘসূত্রিতা দেখে কোনও বিদেশি শিল্প সংস্থা ভবিষ্যতে আর ভারতে বিনিয়োগে উৎসাহ পাবে কি না সেটাই প্রশ্ন। তা ছাড়া কোনও একটি মাত্র প্রকল্পের জন্য কে-ই বছরের পর বছর মূলধন আটকে রাখতে চাইবে!
এই অবস্থায় শিল্প মহল এমনকী সরকারের মধ্যে থেকেই দাবি উঠেছে একটা বিহিত করার, যাতে পরিবেশের স্বার্থ বজায় রেখেও শিল্প স্থাপনের পথ প্রশস্ত করা যায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দু’টি সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। এক, পরিবেশ নীতির শর্ত পরিবর্তন করা বা নীতি প্রবর্তন করে এগোনো। দুই, আদালতের মাধ্যমেই রফাসূত্রে পৌঁছনো।
তবে পস্কোর কারখানা পত্তনের চেষ্টা সরকার যে চালিয়ে যাবে, তার কিছুটা ইঙ্গিত আজ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী জয়ন্তী নটরাজন। তাঁর কথায়, “ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত সরকারের কাছে একেবারেই হতাশাজনক নয়। পরিবেশ মন্ত্রক যথাসম্ভব কঠোর নীতি অনুসরণ করেই প্রকল্পে ছাড়পত্র দিয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল কোন কোন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছে তা খতিয়ে দেখে সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ করবে।” প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ কোরিয়াকে যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে আজকের রায় বড় ধাক্কা কি না, সে প্রসঙ্গে পরিবেশমন্ত্রী বলেন, “আমার মনে হয় না, এই দু’টো বিষয়ের মধ্যে কোনও যোগসূত্র আছে।” সরাসরি মন্তব্য এড়িয়ে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক বলেছেন, “রায়ের কপি পড়ে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারব।” পরে পস্কোর তরফে এক কর্তা বলেন, “আমরা আইন মেনে চলি। যে সমস্ত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা আমরা নিশ্চয়ই মানব।” |
|
|
|
|
|