ভোটব্যাংকের রাজনীতি এবং সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থসিদ্ধি কী ভাবে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাত ঘটাইতে পারে,পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী বেয়ন্ত সিংহের ঘাতক বলবন্ত সিংহ রাজোয়ানার মৃত্যুদণ্ড স্থগিতের ঘটনাপরম্পরায় তাহা স্পষ্ট হইয়া গেল। খলিস্তানি জঙ্গি রাজোয়ানার অপরাধ বিচারে প্রমাণিত। তিনি নিজেও হত্যা-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার দায় অস্বীকার করেন নাই। কিন্তু তাঁহার শাস্তির দিন আসন্ন হইতেই পঞ্জাবের শাসক অকালি দল এবং তাহার সহযোগী শিখ ধর্মীয় সংগঠন শিরোমণি গুরুদ্বার প্রবন্ধক কমিটি (এসজিপিসি) ও স্বর্ণমন্দিরের অকাল তখ্ত এই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে মুখর হয়। রাজ্য জুড়িয়া শিখ ধর্মীয় ও খণ্ডজাতীয় আবেগে উস্কাইয়া অশান্তি ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির কাছে ঘাতকের প্রাণভিক্ষার আবেদনও করা হয়। রাষ্ট্রপতি সে-আবেদন যথাবিহিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে পাঠাইয়া দিলে কেন্দ্র দণ্ড স্থগিতের সিদ্ধান্ত লয়। অর্থাৎ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে খুন করিলেও সে জন্য আততায়ীর যে আইন অনুযায়ী সাজা হইবে, এমন নিশ্চয়তা আর রহিল না।
সুপ্রিম কোর্ট স্বভাবতই এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ। পঞ্জাব সরকারকে এ ভাবে ‘নাটক করা’র জন্য কড়া ভাষায় ভর্ৎসনাও করিয়াছে। এবং সেই তিরস্কার সঙ্গত। জনতার আবেগের দোহাই দিয়া এ ভাবে যদি আইনের শাসনে অন্তর্ঘাত ঘটানো হয়, তবে তো আইনি ব্যবস্থার উপরেই ভরসা চলিয়া যাইবে। রাজোয়ানা ও তাঁহার সঙ্গীরা মানববোমা হইয়া যাঁহাকে হত্যা করেন, সেই বেয়ন্ত সিংহও কিন্তু একজন নিষ্ঠাবান শিখ ছিলেন, উপরন্তু তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী অর্থাৎ রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদাধিকারী। তাই রাজোয়ানার শাস্তি শিখ আবেগকে আহত করিবে, ইহা হাস্যকর যুক্তি, যদি না সেই নেতিবাচক আবেগকে অকালি দল ও এসজিপিসি-র স্বেচ্ছাসেবকরা ইচ্ছাকৃত ভাবে খুঁচাইয়া তোলেন। পঞ্জাবে তাঁহারা ঠিক ইহাই করিয়াছেন, তাহার পর সেই আবেগের পরিকল্পিত ও সংগঠিত বিস্ফোরণকে স্বতঃস্ফূর্ত ‘আন্দোলন’ রূপে দেখাইয়া কেন্দ্রের উপর চাপ সৃষ্টি করিয়াছেন। প্রশ্ন হইল, কেন্দ্র চাপের কাছে নত হইবে কেন? কারণ কেন্দ্রের বর্তমান সরকারটি দ্বিধা, দোলাচল, পশ্চাদপসরণ ও নতিস্বীকারেই অভ্যস্ত একটি সরকার। সদ্যসমাপ্ত পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস আশানুরূপ ফল করিতে পারে নাই। পাছে অকালিদের কুশলী রাজনীতিতে দলের শিখ জনসমর্থন আরও লঘু হইয়া যায়, তাই এই তোষণের সিদ্ধান্ত। ইহা প্রকারান্তরে উগ্রপন্থার তোষণ।
একই ধরনের দ্বিধা ও পশ্চাদপসরণ সংসদে হামলা ও হত্যালীলায় দোষী আফজল গুরুর দণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রেও লক্ষিত হইয়াছে। গুরুর প্রাণভিক্ষার আবেদন যে এখনও রাষ্ট্রপতির দফতরে পড়িয়া আছে, তাহার কারণ, কাশ্মীরের রাজনৈতিক দলগুলি এই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপত্তি জানাইয়াছে। তবে কি এ ভাবেই চলিতে থাকিবে? মুসলিম সংখ্যালঘুদের তোষণের নামে রাজনৈতিক ইসলামের গণহত্যাকারী জঙ্গি জেহাদিদের অপরাধ মার্জনা করা হইবে আর মুখ্যমন্ত্রীকে হত্যা করিয়াও আততায়ী পার পাইয়া যাইবে শিখ সাম্প্রদায়িক আবেগকে প্রশমিত রাখার তাড়নায়? তবে আর দেশে আইনকানুন, আইনরক্ষক, সংবিধান, আদালত রাখার প্রয়োজন কী? বাস্তবতা কিন্তু অন্য কথা বলে। মুসলিম জেহাদিদের যেমন মৌলবাদী উলেমা-মোল্লারা ছাড়া সাধারণ মুসলিম জনতা সমর্থন করে না, খলিস্তানি জঙ্গিদেরও তেমনই সমগ্র শিখ সমাজের সমর্থন নাই। ন্যক্কারজনক ভোটব্যাংকের রাজনীতি ইতিপূর্বেই ব্যুমেরাং হইয়া জাতির নিরাপত্তা বিপন্ন করিয়াছে। ভবিষ্যতেও করিতে থাকিবে। |