অর্থ যে দেয়, তাহার কথা শুনিতে হয় এমন একটি তত্ত্ব জনারণ্যে প্রচলিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথা তাহার মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত সেই তত্ত্বের সম্পূর্ণ বশীভূত। সরকারি গ্রন্থাগারে স্বাভাবিক ভাবেই টাকা দেয় সরকার। সুতরাং, সরকারি গ্রন্থাগারে কোন কোন সংবাদপত্র কেনা হইবে, তাহাও সরকারই স্থির করিয়া দিবে। সহজ নীতি। সহজ মাত্রেই যথাযথ নয়। এই নীতি ভুল। নীতি হিসাবে ভুল। রাজ্য সরকারের গ্রন্থাগার দফতর সরকারি গ্রন্থাগারে কোন সংবাদপত্রকে স্থান দিতে চাহে, কোন সংবাদপত্রকে স্থান দিতে চাহে না তাহা নীতিগত ভাবে গৌণ প্রশ্ন। মুখ্য প্রশ্ন একটিই। গ্রন্থাগারে কোন সংবাদপত্র রাখা হইবে, সেই বিষয়ে সরকারের আদৌ কোনও মতামত থাকিবে কেন, আর থাকিলেই বা সরকার সেই মতামত গ্রন্থাগারের উপর চাপাইয়া দিবে কেন? ইহা মৌলিক প্রশ্ন। গণতন্ত্রের মূল শর্ত রক্ষার প্রশ্ন। গণতন্ত্র কেবল পাঁচসালা ভোটের পরম্পরা নয়, গণতন্ত্র কেবল কিছু সংসদ, বিধানসভা ইত্যাদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান চালাইবার রীতিও নয়, গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি নিহিত থাকে গণতান্ত্রিক মানসিকতায়। যাঁহারা রাজবৃত্তের শীর্ষাসনে তথা উচ্চস্তরে আসীন, তাঁহারা যদি সেই মানসিকতায় দীক্ষিত না হন, তাঁহাদের কথায় ও কাজে যদি তাহার বিপরীত লক্ষণ ক্রমশই স্পষ্ট হইতে থাকে, তাহা গভীর আশঙ্কার লক্ষণ, বড় বিপদের সঙ্কেত। পশ্চিমবঙ্গে সেই সঙ্কেত নানা ভাবে প্রকট হইতেছে। গ্রন্থাগার কাহিনি তাহার আরও একটি নজির। একটি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং অবান্তর বিষয় লইয়া সরকার এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যে কুনাট্য রচনা করিয়াছেন এবং করিয়া চলিয়াছেন, তাহা কল্পনাকেও হার মানায়।
কেন গ্রন্থাগারের বই বা পত্রপত্রিকার নির্বাচনে সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ বিধেয় নহে? কেন এই বিষয়ে কোনও ধরনের নির্দেশ অনৈতিক? তাহার কারণ, সরকার কোনও ব্যক্তি বা পরিবার নহে, গণতন্ত্রে সরকার জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত, জনসাধারণের অছি। শাসক দল বা গোষ্ঠীর নহে, সমস্ত নাগরিকের। এই কারণেই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান কী করিবে, কী করিবে না, সেই বিষয়ে সরকার যত কম হস্তক্ষেপ করে, ততই মঙ্গল। তাহা না হইলে সরকারি হস্তক্ষেপ দলীয় হস্তক্ষেপে পর্যবসিত হইতে বাধ্য। তাহার বহু নমুনা গত তিন দশক ধরিয়া বামফ্রন্টের পশ্চিমবঙ্গ দেখিয়াছে। ২০১১ সালের পরিবর্তন-এর নিকট প্রথম ও প্রধান দাবি ছিল দলতন্ত্র হইতে, গোষ্ঠীতন্ত্র হইতে যথার্থ মুক্ত উদার গণতন্ত্রে পরিবর্তন। যে গণতন্ত্রে সরকার তথা শাসকরা আপনাকে জনজীবন হইতে যথাসম্ভব দূরে সরাইয়া রাখিবেন, সমাজকে আপন রুচি ও বিচার অনুসারে চলিতে দিবেন। কে কী পড়িবে, কে কী লিখিবে, কে কী গাহিবে, কে কী শুনিবে, তাহা যদি সরকারের নিকট জানিয়া লইতে হয়, তবে তো স্তালিনবাদই বরণীয়। দুনিয়ার বহু দেশেই সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত গ্রন্থাগার আছে। কিন্তু সরকার টাকা দেয় বলিয়া কেনা-না-কেনার তালিকাও সরকার ঠিক করিয়া দিবে, ইহা কোনও সভ্য, গণতান্ত্রিক সরকার ভাবে না, ভাবিতে পারে না। যাহারা ভাবে, তাহারা হয় গণতান্ত্রিক নহে, অথবা সভ্য নহে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আপন অভিধা এবং বিশেষণ স্থির করিয়া লইতে হইবে। শাসকদের মানসিকতা এবং আচরণ একটি রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়িয়া তুলিবার পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘকাল যাবৎ দলানুগত প্রশাসনের মানসিকতায় চালিত হইয়াছে। জমানা বদলের পরে সেই মানসিকতাই আরও প্রকট এবং আরও স্থূল অবয়ব পরিগ্রহ করিবে? স্তালিনবাদী জমানা হইতে অধিকতর স্তালিনবাদী জমানায় অবতরণই কি তবে পরিবর্তন? |