সিনেমা সমালোচনা...
ব্যোমকেশ সফল, পরিচালক নন
ব্যোমকেশ সিরিজের দ্বিতীয় ছবি বাহির হইয়াছে। কাল সন্ধ্যায় আমি আর ব্যোমকেশ দেখিতে গিয়াছিলাম। ছবি দেখিয়া ব্যোমকেশ প্রফুল্ল হইল ঠিকই। কিন্তু একই সঙ্গে তাহার কপালে অনেকগুলি ভাঁজ দেখিলাম। অনেক বার জিজ্ঞাসা করিলাম, সে কিছুই বলিতে চাহিল না। কেবল বলিল, তুমি সাহিত্যিক মানুষ! যা বলিবার তুমিই বলো! আমার কাজ সত্যান্বেষণ।
অগত্যা কলম ধরিতে হইল।
‘আবার ব্যোমকেশ’ সম্পর্কে একটিমাত্র বিশেষণ প্রয়োগ করিলে কী করিব? নয়নাভিরাম।
গল্পে ছিল, সাঁওতাল পরগনা। ছবিতে, উত্তরবঙ্গ। ‘চিত্রচোর’-এর চিত্রপট বড় সুন্দর লাগিল।
‘আদিম রিপু’তে ঘটনার ঘনঘটা অনেক বেশি ছিল। গল্পটি অনেক লম্বাও ছিল। ‘চিত্রচোর’-এ, আজিকার ভাষায় যাহাকে ‘অ্যাকশন’ বলা হইতেছে, তাহা কম। নিরিবিলি ছোট্ট শহরে একটা গ্রুপ-ফেটা খোওয়া যাওয়ার মতো মামুলি ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া রহস্য। হাওয়া বদল করিতে গিয়া আমি, ব্যোমকেশ ও সত্যবতী সেই রহস্যের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলাম। এই কাহিনি থেকে বায়োস্কোপের উপযোগী সাসপেন্স-থ্রিলার তৈরি করা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। এবং সেখানেই এই ছবির সাফল্যযে এত কম ঘটনা, এত দুলকি গতির মধ্যে থাকিয়াও একটি আদ্যন্ত রহস্য গল্পের চিত্রনাট্য তৈরি করার সাহস দেখাইয়াছেন পরিচালক অঞ্জন দত্ত।
ব্যোমকেশও এই কথাটাই বারে বারে বলিতেছিল। বলিতেছিল যে সে বার সাঁওতাল পরগনায় যে ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহাতে রহস্যের থেকে বেশি ছিল তার রোখ। আশেপাশের মানুষগুলোর গর্ব এবং উন্নাসিকতায় ও এতটাই বিরক্ত হইয়াছিল যে রহস্য উন্মোচনের পথে আসলে তাদের চারিত্রিক ভঙ্গুরতাগুলিই ও উন্মোচিত করিতে চাহিয়াছিল। ‘আবার ব্যোমকেশ’-য়ে পরিচালক যে ‘চিত্রচোর’ গল্পের সেই আত্মাকে ধরিয়াছেন, তাহা আমার বেশ লাগিয়াছে। আর ভাল লাগিয়াছে রহস্যের ফাঁকে, ফাঁকে অবলীলায় ব্যোমকেশ-সত্যবতীর গার্হস্থ্যকে মিলাইয়া দেওয়া। তাহার জন্য হয়তো ছবির গতি মাঝেমধ্যে ধাক্কা খাইয়াছে, কিন্তু সেটিই তো এই গল্পের দাবি।
সবচেয়ে বড় কথা, এই মহাগতিময় যুগের আধারে বসিয়াও পঞ্চাশের দশকের এক ধুতি-পাঞ্জাবি পরা কম্পিউটার-মোবাইলবিহীন সত্যান্বেষীকে পর্দায় মানুষকে দেখিতে বাধ্য করিয়াছেন যাঁহারা, তাঁহাদের প্রতি আমার কুর্নিশ।
আবার ব্যোমকেশ
আবির, শাশ্বত, ঊষসী, কৌশিক, বিশ্বজিৎ, স্বস্তিকা, চন্দন
সুদীপা, দেবরঞ্জন, সুজন, পীযূষ, দেবরঞ্জন
সত্যবতী ছবি দেখিতে থিয়েটারে যাইতে পারে নাই আমাদের সঙ্গে। উত্তরবঙ্গের দৃশ্যাবলি যে ভাবে দেখানো হইয়াছে, সত্যবতী ছবিটি দেখিলে বিলক্ষণ যাইতে চাহিত!
কিন্তু নয়নাভিরাম বলিলাম তাহার আরও কারণ, ছবির আদ্যন্ত ‘গ্রেনি লুক’খানি। পুরনো বইয়ের রঙিন ছবির রূপ-গন্ধ মনে পড়াইয়া দেয়। ‘গন্ধ’ শব্দটি খুব ভেবেচিন্তেই লিখিলাম। মনস্তত্ত্ববিদরা একে বলিবেন, ল’জ অফ অ্যাসোসিয়েশন। অনুষঙ্গের নিজস্ব নিয়ম। সেই নিয়মেই ছবিটি দেখিতে দেখিতে পুরনো বইয়ের গন্ধ মনে পড়িতে বাধ্য! সুতরাং সবার আগে চিত্রগ্রাহক ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়কে আমার শুভেচ্ছা!
অঞ্জন দত্তের পরিচালনায় ব্যোমকেশ সিরিজের আগের ছবিতেও ইন্দ্রনীলকে একই দায়িত্ব পালন করিতে দেখিয়াছিলাম। কিন্তু সে ছবি আর এ ছবির মধ্যে সমূহ পার্থক্য। আগের ব্যোমকেশের দৈন্যদশা এ বারে অনেকটা কাটাইয়া ওঠা গিয়াছে। নীল দত্ত আগের ছবিতেই ‘ব্যোমকেশ-থিম’ নির্মাণ করিয়াছিলেন। এ বারে সেই থিম আরও মজবুত হইয়াছে, আরও মূর্ছনা যোগ হইয়াছে। সুতরাং আমার দ্বিতীয় শুভেচ্ছা-বার্তাটি নীলের জন্য।
মজবুত হইয়াছে আরও একটি জিনিস। ব্যোমকেশ-রূপী আবির এবং আমার চরিত্রে শাশ্বত প্রথম ছবিতেই আমাদের আকর্ষণ করিয়াছিল। এবার তার সঙ্গে যোগ হইল সত্যবতী-রূপী ঊষসী চক্রবর্তীর উপস্থিতি। তিনজনের রসায়ন (নাকি ত্রিকোণমাত্রিক প্রেমই বলিব?) দেখে পুরনো দিনগুলো মনে পড়িতেছিল। সত্যবতী-ব্যোমকেশের খুনসুটি, কলহ এবং তাহার মধ্যিখানে পড়িয়া আমার কিংকর্তব্যমিমূঢ় অবস্থাএ মুহূর্তগুলো এত সুন্দর ফুটিয়া উঠিয়াছে এ ছবিতে, যে কী বলিব!
তা বলিয়া কি সর্বাঙ্গসুন্দর এই ছবি? কোনও খুঁত নাই? তাহা কী করিয়া হইবে? গল্পে খুঁতই যদি না থাকিবে, তাহা হইলে গোয়েন্দা ধরিবেটা কী?
আমি লিখিয়াছিলাম, মহীধরবাবু সকালে উঠিয়া দেখেন ছবিটি নাই। এখানে ছবি শুরুই হইল, চুরির দৃশ্য দিয়া। চোর জানলার কাচ ভাঙিয়া ঢুকিল। ফোনের রিসিভার নামাইয়া রাখিল (অত রাতে কার ফোন আসিয়াছিল? অশ্বিনীর? গল্প এই পথেও অগ্রসর হইতে পারিত। হইল না।) মহীধর (বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী) জাগিয়া গেলেন। তার ফল কী হইল? ছবি চুরি প্রথম থেকেই মামুলি ঘটনা রহিল না। আর মহীধরবাবুকে ঘুম থেকে তুলিয়া দেওয়ার অর্থ হইল, মহীধরবাবু আর কোনও মতেই সন্দেহের তালিকায় থাকিতে পারিলেন না। তিনিও মিথ্যা বলিতে পারেন, এমন সন্দেহের অবকাশ রহিল না। একই কথা প্রযোজ্য ঊষানাথ (চন্দন সেন) সম্পর্কেও। তাঁহাকেও মাথায় বাড়ি খাওয়াইয়া গোড়াতেই সন্দেহ-তালিকা থেকে বার করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তা সত্ত্বেও অজিত কেন ক্লাইম্যাক্সের আগে দুই সন্দেহভাজনের মধ্যে ঊষানাথকে রাখিয়া দিল, বোধগম্য নয়। ঊষানাথবাবুর এক চোখ কানা। কালো চশমা পরিয়া থাকেন। রাতে ঘরে চোর ঢুকিল, তখনও চোখে চশমা। সকালের একটি দৃশ্যে তিনি চশমা খুলিলেন এবং দেখা গেল, তাঁহার দু’টি চোখই বাঙ্ময়! মহীধরবাবু রক্ষণশীল মানুষ। অথচ বিধবা রজনী (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতো শক্তিশালী অভিনেত্রী ওইটুকু চরিত্রে তিনি কী করিতেছিলেন মাথামুন্ডু কিছুই বুঝিলাম না) স্কার্ট-ব্লাউজ পরিয়া জঙ্গলে ঘুরিতেছে! তা ছাড়া পর্দার সত্যবতীকে আমার একটু বেশিই মুখরা লাগিয়াছে।
সবচেয়ে বড় কথা ছবির প্রথমে গরমের ছুটিতে দিন দশেকের জন্য বেড়াইতে যাওয়ার কথা বলা হইল, অথচ শেষে দেখা গেল সব চরিত্রই বড়দিনের ছুটি কাটাইতে কলিকাতা অভিমুখী। দশ দিনে বছর শেষ কী ভাবে সম্ভব ইহা বোধগম্য হইল না।
তবে অশ্বিনী (সুজন মুখোপাধ্যায়)-রজনী-আদিনাথ সোম (পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়)-মালতীর (সুদীপা বসু, বড় ভাল অভিনয় করিয়াছেন) সম্পর্কের টানাপোড়েন গল্পের মতোই ছবিতেও একই মাত্রা যোগ করিয়াছে বলিয়াই মনে হইল। আর চিত্রকর ফাল্গুনি পালের (দেবরঞ্জন নাগ) চরিত্রটি বেশ প্রাঞ্জল ভাবে আসিয়াছে।
আর একটি কথা। আগের ছবিতে ‘আদিম রিপু’র কাহিনি ১৯৬৪ সালে আগাইয়া আনা হইয়াছিল। এ ছবিকে উহার সিক্যুয়েল বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। তাহা হইলে সময়কালকে মধ্য ষাট ধরিতে হয়। সে ক্ষেত্রে ‘মাদার ইন্ডিয়া’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এর মতো পঞ্চাশের শেষ দিককার ছবির পোস্টার কী কারণে? মহীধর বা ঊষানাথের অন্দরসজ্জাতেও মধ্য ষাটের ছাপ কম। আর সবচেয়ে বড় কথা, যে সময়ে বহু মানুষই দুইশত টাকা মাহিনা পাইতেন কি না সন্দেহ, সে সময়ে কথায়, কথায় একশত, দুইশত টাকা বকশিস দিচ্ছেন চরিত্ররা! বড়ই অবাক হইলাম।
অমরেশের (কৌশিক সেন) চরিত্রে একটি নূতন মাত্রা যোগ হওয়া সত্ত্বেও ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যটিও কিন্তু একটু দুর্বলই রহিল বলে মনে হইল। বন্দুক তাক করিয়া অত লম্বা কথোপকথন বেশ একটু অবাস্তবই ঠেকিল যেন।
সবশেষে বলি ব্যোমকেশ-রূপী আবির চট্টোপাধ্যায়ের কথা। ‘আদিম রিপু’র থেকে ‘চিত্রচোর’-এ তাঁর অভিনয় তীক্ষ্মতর হইয়াছে। এ বিষয়ে ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করাতে সে মুচকি হাসিয়া বলিল, “ভালই তো। অভিনয়ও এক প্রকার সত্যান্বেষণ। তবে অন্বেষণের কোনও শেষ নাই।” অবশ্য মুখে যাহাই বলুক, পরিষ্কার মনে আছে আগের ছবি দেখে ব্যোমকেশ ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া প্রেক্ষাগৃহ হইতে বাহির হইয়াছিল। এ বার কিন্তু আবিরকে যত বার দেখিয়াছে, অন্ধকারের মধ্যেও বোঝা যাইতেছিল তাহার ঠোঁটের কোণে বেশ তৃপ্তির হাসি।
নিজের মুখে অজিতের কথা লিখিতে বাধো বাধো ঠেকিতেছে। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় আমাকে মুগ্ধ করিয়াছেন! প্রতিটি মুহূর্তে এত অজস্র ব্যঞ্জনা তিনি বুনিয়া দিয়াছেন তাঁর অভিনয়ে, বিভোর হইয়া দেখিতেছিলাম!
মোটের ওপর ‘আদিম রিপু’র চেয়ে ‘চিত্রচোর’ আমাদের বেশি ভাল লাগিয়াছে। কিন্তু বায়োস্কোপের পর্দায় রহস্য গল্প যে ঠাসবুনোট দাবি করিয়া থাকে, এ ছবিতে সে ব্যাপারে খানিক দুর্বলতা এবারও প্রত্যক্ষ করিলাম। ছবির পরিচালক অঞ্জন দত্ত তো শুনিয়াছি জাতীয় পুরস্কার জয়ী। তাহা হইলে ‘পিরিয়ড পিস’ করিতে গিয়া ‘ডিটেলিং’-য়ের প্রতি এত অমনোযোগ কেন?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.