রবিবাসরীয় গল্প
অস্তরাগ
টো থেকে নেমে কয়েক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে রইল সুজাতা। মনে মনে ঝালিয়ে নিল ঠিকানাটা। বীথি কাল যেমনটা বলেছিল তাতে তো বাসরাস্তা থেকে দূরে হওয়ার কথা নয়। হাঁটাপথে বড়জোর মিনিট পাঁচেক। একটা রিকশা নিয়ে নেবে? থাক গে, বয়স যাই হোক এখনও তো পা দুটো অচল হয়নি।
অঘ্রানের দুপুর। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। একটা মলিন রোদ বিছিয়ে আছে শহরের গায়ে। বাতাসে সামান্য শিরশিরে ভাব। তাঁতের শাড়ির আঁচলখানা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে সুজাতা চলা শুরু করল। ক’পা গিয়ে ঘড়ি দেখল কব্জি উল্টে। অমনি মন খচখচ। আড়াইটে বাজে, আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নাতিনাতনি স্কুল থেকে ফিরবে হুড়মুড়িয়ে। ওই সময়টায় সুজাতার বাড়িতে না থাকাটা কি ঠিক হল? মাম্পি ভুতুমের অবশ্য ঠাম্মাকে আর তেমন প্রয়োজন হয় না, তাকে আর সে ভাবে ওরা আমলও দেয় না। ঠাম্মা নামের একটা মানুষ আদৌ ঘরে আছে কি নেই, সেটুকুও খেয়াল করবে কি না সন্দেহ। বৈকালিক জলখাবার বানিয়ে দেওয়ার জন্যে বাড়িতে মালতী মজুত, তড়িঘড়ি ইউনিফর্ম ছেড়ে, নাকেমুখে যা হোক গুঁজে, ভাইবোন তো ধাঁ মারবে যে যার মতো। মাম্পি যাবে টিউশন পড়তে, ভুতুম সামনের পার্কে। অতএব তাদের কথা ভেবে সুজাতার গৃহে অবস্থান করাটা তো নেহাতই মূল্যহীন, নয় কি?
তবু চিন্তা পিছু ছাড়ে কই। যদি কোনও কারণে সময় মতো না ফেরে ছেলেমেয়ে দুটো? যদি পথে স্কুলবাস খারাপ হয়? যদি অন্য কোনও সমস্যায় আটকা পড়ে স্কুলে? রুমা তো মাঝে মাঝেই চারটে নাগাদ ফোন করে অফিস থেকে, খোঁজখবর নেয় ছেলেমেয়ের। তখন যদি শোনে ওরা এখনও আসেনি, ও দিকে শাশুড়িঠাকরুন কোথাও একটা চরতে বেরিয়ে গিয়েছে, রুমা খুব প্রীত হবে কি? মুখে হয়তো বলবে না কিছু, তাও...।
নাহ্, রুমাকে বোধ হয় সকালে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কী করবে, আজই যে বীথির ডেরায় ছুটবে এমন তো পরিকল্পনা ছিল না। বহু দিন পর কাল বীথির ফোনটা পেয়ে জোর চমকেছিল বটে, অবিলম্বে দেখা করার বাসনাও জেগেছিল, তার পর সন্ধেবেলা টিভি সিরিয়াল দেখতে দেখতে কখন যেন চাপাও পড়ে গিয়েছিল ইচ্ছেটা। সকালে বাড়ি ফাঁকা হতে ফের কৌতূহলটা এমন চাগাড় দিয়ে উঠল!
যাক গে, মরুক গে, অত টেনশন করার কোনও মানেই হয় না। সুজাতার হাতে সংসারটা ছাড়া থাকে বলে তার কি ইচ্ছেমতো বেরোনোর স্বাধীনতাও নেই? রুমা কবে দেরিতে ফিরবে, বাবুন কবে অফিস টুরে বাইরে যাবে, কিছু কি আগে থেকে জানতে পারে সুজাতা? বলার প্রয়োজন বোধ করে কেউ? পরশুই তো দু’জনে কোন বন্ধুর ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে গেল, রাত্তিরে যে তারা খাবে না, শুনতে হল কিনা মালতীর মুখ থেকে! তা হলে...?
চিন্তা ছিঁড়ে গেল সহসা। শান্তিনীড় এসে গিয়েছে।
কালো গেটের গায়ে সাদা হরফে লেখা নাম-ঠিকানাটা চোখ কুঁচকে এক বার পড়ল সুজাতা। তার পর চশমা ঠিক করে ভেজানো গেট ঠেলে ঢুকেছে অন্দরে। সামনেই একফালি সবুজ। তিন ধারে তার মরশুমি ফুলের সমারোহ। গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, পমপম...। কুঁড়ি এসেছে ডালিয়ায়, ছোট ছোট গাঁদা ঝিকঝিক হাসছে। মাঝখানে একটা তুলসীমঞ্চও আছে। বাঁধানো। বাগান ঘিরে ইউ শেপের দোতলা বাড়ি, টানা বারান্দাওয়ালা। সুজাতা যেখানে দাঁড়িয়ে, তার ওপারেই বুঝি অফিসঘর। কারা যেন কাজ করছে সেখানে।
অদ্দূর অবধি অবশ্য যেতে হল না। তার আগেই এক বয়স্কা মহিলা একতলার সরু বারান্দায় কাকে খুঁজছেন?
সুজাতা এক পা এগোল বীথি... মানে বীথিকা ঘোষাল...?
বীথি? একটু দাঁড়ান, ডেকে দিচ্ছি।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই চটি মশমশিয়ে বীথির আবির্ভাব। সুজাতার মতো ভারিক্কি হয়নি শরীর, একই রকম রোগা আছে এখনও। একই রকম ঋজুও।
বীথির লম্বাটে মুখে একগাল হাসি ওমা, তুই? আজই আসবি, কাল তো বললি না?
সুজাতা মিটিমিটি হাসছে তুই একাই সারপ্রাইজ দিবি নাকি? ভাবলাম আমিও তোকে...
বেশি করেছিস। আয়।
হাত ধরে প্রায় কিশোরীর উচ্ছলতায় সুজাতাকে দোতলায় নিয়ে এল বীথি। যেতে যেতে বকে যাচ্ছে অবিরাম। এখন নাকি একতলার বড় ঘরে টিভি দেখছিল অনেকে মিলে। দুপুরের দিকে এই সময়টায় টিভি সিরিয়াল দেখা নাকি একটা ছল, দিবানিদ্রা এড়ানোর জন্য নাকি জড়ো হয়, নাম কা ওয়াস্তে টিভি চলে, যে যার মতো গল্প করে যায়। এতে নাকি দুপুরগুলো হুশহুশিয়ে কাটে।
টানা বারান্দার প্রায় শেষ প্রান্তে নিজের ঘরখানায় সুজাতাকে এনে বসাল বীথি। ছোট্ট ঘর, মেরেকেটে দশ বাই দশ। তার মধ্যেই একটা সিঙ্গল বেড খাট, ছোট আলনা, বেঁটে আলমারি, এক সেট টেবিল-চেয়ার, খুদে টিভি স্ট্যান্ড। দেওয়ালে আয়না, দরজার ধারে ছোট টুলে জলের কুঁজো। এত জিনিস ঢুকল কী করে এখানে? লাগোয়া একটি বাথরুমও আছে, আয়তনে ঘরের সঙ্গে মানানসই, শাওয়ার প্রায় কমোডের ওপর ঝুলছে।
পলকের জন্য বীথির শ্বশুরবাড়িখানা ভেসে উঠল সুজাতার চোখে। প্রাচীন বাড়ির একটা অংশে থাকত বটে, কিন্তু কী বিশাল বিশাল ঘর। কত বছর আগে গিয়েছিল সুজাতা, তবু এখনও মনে গেঁথে আছে। কী এমন হল, যাতে ঠাঁই নাড়া হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের এই খুপরিতে এসে মাথা গুঁজতে হল বীথিকে?
প্রশ্নটা জিভে এসে গিয়েছিল, তার আগেই বীথি জিজ্ঞেস করল কী রে, চা খাবি তো?
এখন...? সুজাতা একটু আমতা আমতা করল তোদের লোকজনরা বিশ্রাম করছে...
তুৎ। ঘরেই বানাব। ইলেকট্রিক কেটলি আছে।
বানা তা হলে। আমি কিন্তু চিনি-দুধ খাই না।
আমিও না। খাটের তলা থেকে বৈদ্যুতিক কেটলিখানা বার করল বীথি। বোর্ডে প্লাগ গুঁজে আন্দাজ মতো জল চড়িয়ে দিয়ে বলল, তোকেও কি শুগারে ধরেছে? আমার মতো?
না রে, মুটিয়ে যাচ্ছি তো। বিছানায় বসল সুজাতা আর দুধটা না খেলে অম্বলও কম হয়।
ভালই করেছিস। চা-ই তো আসল। দুধ-চিনি তো বাহুল্য। বীথি মুচকি হাসল, আমার যেমন এই ঘরটুকুতেই কুলিয়ে যায়। ভবানীপুরের বাড়ির এত এত জায়গাকে এখন বাড়তি বলে মনে হয়।
কিছু যেন গোপন করছে বীথি। সন্দিগ্ধ স্বরে সুজাতা বলল, সেই জন্যই বুঝি চলে এসেছিস?

বীথি জবাব দিল না। জল ফুটে গিয়েছে, দেওয়ালের র্যাক থেকে চা-পাতা পাড়তে পাড়তে আনমনে বলল, কত দিন পর তোর সঙ্গে দেখা হল?
তা প্রায় ষোলো বছর। সেই স্কুলের গোল্ডেন জুবিলিতে তুই গিয়েছিল, বেশিক্ষণ থাকলি না... তখনই বোধ হয় তোর বরের অসুখটা...
হুম্। তার চার মাস পরেই তো চলে গেল। বীথি ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল, ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। সনু তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছে, রাজা হায়ার সেকেন্ডারি দেবে...।
এগারো বছর আগে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে চলে যাওয়া সেই নিজের মানুষটিকে যেন ঝলক দেখতে পেল সুজাতা। ব্যাঙ্কের ব্যস্ত অফিসার রিটায়ারমেন্টটাকে যেন মানতেই পারল না। কী অদ্ভূত এক ছটফটানিতে ভুগত সারাক্ষণ। বছর ঘুরতে না ঘুরতে মৃত্যু এসে সব চাঞ্চল্য ঘুচিয়ে দিল। তখন সে সুজাতার মনের ওপর দিয়ে কী ঝড় গিয়েছে। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। এখনও কি থিতিয়েছে পুরোপুরি?
যেন বীথিকে নয়, যেন নিজেকে শুনিয়ে সুজাতা বলল, জানি রে। সহেলিদের মুখে শুনেছি তুই কারও সঙ্গে আর মিশতিস না, কোথাও যেতিস না...
ভাল লাগত না। কিচ্ছু ভাল লাগত না তখন। সারা দিন শুধু শুয়ে থাকতাম। কেমন জবুথবু মেরে গিয়েছিলাম। আমাকে চাঙ্গা করার জন্য সনু বোধ হয় তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেলল। সুজাতাকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে ম্লান হাসল বীথি কিন্তু লাভ কী হল? সনুর বউকে নতুন খেলনা ভেবে গড়েপিটে মানুষ করতে চাইলাম। তবে তাই কি হয়? সে এখনকার মেয়ে, সে মানবে কেন? হঠাৎ এক দিন শুনলাম, ছেলে চাকরি বদলে চলে যাচ্ছে দিল্লি। তখন বুঝিনি, ছেলে ছেলের বউকে চরম স্বার্থপর ভেবেছি। এখন টের পাই, আমার পুতুলখেলার বাড়াবাড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে তারা পালিয়েছে।
কাপে চুমুক দিয়ে চা’টা কেমন বিস্বাদ ঠেকল সুজাতার। বাবুন আর রুমার সঙ্গে তার সম্পর্কটা ঠিক এই ধরনের নয় ঠিকই, তবে বাবুনের বিয়ের জন্য সে উঠে পড়ে লেগেছিল অনেকটা তো সেই কারণেই। বাবুনের বউ তার সঙ্গী হবে, তাকে একাকিত্ব থেকে মুক্তি দেবে...। চাকরি করা মেয়েকে বাবুন নিজে পছন্দ করে বিয়ে করল সুজাতা যে একা সেই একাই। এখনও কি সে রুমাকে মন থেকে মানতে পেরেছে? মাঝখান থেকে সে বনে গিয়েছে বাবুন আর রুমার সংসারের পাহারাদার।
মনোবেদনা গোপন রেখে সুজাতা আলগোছে প্রশ্ন করল, তোর বড় ছেলে কি এখনও দিল্লিতে?
নাহ্। আরও দূরে। দুবাই চলে গিয়েছে।
আর ছোটটার কী খবর?
এখানেই আছে। চাকরিবাকরি করছে।
বিয়ে দিয়েছিস তো?
আমি আর দেওয়াদেয়িতে ছিলাম না। নিজেরাই করেছে। বীথি খালি কাপ দু’খানা রাখল টেবিলে। কী যেন ভাবতে ভাবতে ছিটের পর্দা ঘেরা জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আপন মনে বলল, ঠিক করেছিলাম এ বার আর কোনও কিছুতে নাক গলাব না। যথাসম্ভব দূরে দূরে থাকব। তাতেও কি স্বস্তি মিলল?
কেন? অসুবিধে কী হল?
সংসারে ওটাই তো আয়রনি রে। তুই ভাববি এক, লোকে তোকে বুঝবে আর এক। বীথি পায়ে পায়ে খাটে ফিরল। সুজাতার মুখোমুখি বসে বলল, রাজা আর রাজার বউয়ের মনে হতে লাগল ওদের আমি সহ্য করতে পারি না। নরম ভাবে কিছু বললে ভাবে প্যাঁচ কষছি। স্বর কড়া হলে তো কথাই নেই, দু’জনে হুলুস্থুলু বাধিয়ে পাড়া মাথায় করবে। এমন একটা অবস্থা দাঁড়াল, শামুকের মতো খোলে গুটিয়ে থাকি...। তখনই ভেবে দেখলাম যৎসামান্য সঞ্চয় তো আছে, ফ্যামিলি পেনশনও কিছু খারাপ পাই না, ওই দিয়ে কোনও মতে যদি...
ওল্ড এজ হোমে চলে এলি?
সহজে এন্ট্রি পাইনি। দরখাস্ত করে লাইন দিয়ে বসেছিলাম। কপাল ভাল, হঠাৎ দু’তিনটি সিট একসঙ্গে খালি হল এখানে...
ছেলে, ছেলের বউ আসতে দিল?
প্রথমে খানিক গাঁইগুঁই করছিল। লোকের কাছে মুখ দেখানো বলেও একটা কথা আছে না? তবে আমার জেদের সঙ্গে পেরে উঠল না।
সুজাতা ক্ষণিক ভাবার চেষ্টা করল, সে যদি এ রকম চলে আসতে চায় কী প্রতিক্রিয়া তবে বাবুন-রুমার? মাম্পি ভুতুমও কি মেনে নিতে পারবে? প্রস্তাবটা পেড়ে এক বার পরখ করে দেখলে হয়।
হঠাৎই সুজাতার গা শিরশির করে উঠল। কেন যে করল?
তাড়াতাড়ি বলে উঠল, তুই ছ’মাস হল এসেছিস, তাই না রে?
একটু বেশি। সাত মাস।
ওরা আসে দেখা করতে?
ওই... সময় সুযোগ পেলে...। আমিও যাই। মায়া বলে তো একটা ব্যাপার আছে, না কী? সেটাকেই বা পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলি কী করে? এই তো, নাতনির জন্য মন কেমন করছিল বলে পুজোর পুরো একটা দিন ভবানীপুরে কাটিয়ে এলাম।
এখানে তা হলে খুব সুখে নেই? কথাটা বলতে পেরে সুজাতা যেন একটা গোপন স্বস্তি বোধ করল। পলকা ঠাট্টার সুরে বলল, মন তা হলে খারাপ হয়?
অবশ্যই। আমি তো পাথরের মানুষ নই। আর মনও তার নিজের নিয়মেই চলে। কপালে এক গাছি চুল এসে পড়েছিল, আঙুল দিয়ে সরাল বীথি। ঈষৎ কেঠো গলায় বলল, তবে একটা সত্যি কথা শুনে রাখ। আমি এখানে মোটেই খারাপ নেই। ইচ্ছে মতন খাচ্ছিদাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, গল্পগুজব করছি, প্রাণ চাইলে বেরিয়েও পড়ি এ দিক ও দিক। কাজকম্মোও করছি না যে তা নয়। সেই স্কুলের মতো দল জুটিয়ে এখানেই ফাংশন চলছে। কবিতাপাঠ, গান, যে যা পারে শোনায়। সামনের বার বসন্তোৎসবও হবে। এ ছাড়া আলপনা দেওয়ার প্রতিযোগিতা, রান্নার কম্পিটিশন...। এখন তো প্ল্যান করছি, পাশের বস্তির ছেলেমেয়েগুলোকে লেখাপড়া শেখাব।
এ বার হাসি পেয়ে গেল সুজাতার। খানিক ব্যঙ্গের সুরে বলল, বুঝেছি।
বীথি চমকে তাকাল, কী? কী বুঝেছিস?
এই সব সাতসতেরো নিয়ে নিজেদের একটু ব্যস্ত রাখিস, যাতে মনের কষ্টটা কম হয়।
আমিও প্রথম প্রথম তাই ভাবতাম রে। এখন বুঝি, এটা অন্য কিছু।
কী রকম?
আমার জীবনটা তুই ভাব। বিয়ের পর থেকে বর আর দুই ছেলে ছাড়া আমার তো কোনও জগৎই ছিল না। বরও ততটা নয়, যতটা দুই ছেলে। তাদের পড়াশুনো, তাদের কেরিয়ার, তাদের যাতে ব্রাইট ফিউচার হয় তাই নিয়ে ভাবনা... এতেই তো গড়িয়ে গেল বিশ-পঁচিশটা বছর। তার পর হঠাৎ এক দিন দেখলাম ওরা কেউ আর আমার আঁচলে নেই, ডানা মেলে যে যার মতো উড়ছে। তখন আমার আর কিচ্ছু করার নেই। জীবনটা বিলকুল ফাঁকা। তাই বোধ হয় ছেলের সংসারে বেশি বেশি করে জড়িয়ে পড়ছিলাম। জোর করে। সনু ঠোক্কর দিয়ে আমায় বুঝিয়ে দিল, তুমি মা হতে পারো, কিন্তু আমার সংসারে তুমি অনুপ্রবেশকারী। সেটা এমনই মজ্জায় মিশে গেল, রাজার সংসারে আর স্বাভাবিক হতে পারলাম না। বীথি একটু দম নিল, এখানে এসে টের পাচ্ছি, আমি শুধু রাজা সনুর মা নই, প্রশান্ত ঘোষালের বউ নই, এর বাইরেও একটা বীথিকা ছিল। যাকে ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক, আমি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম। সেই বীথিকাটাই এখন এই শান্ত নীড়ে বাস করতে এসেছে। যদ্দিন শরীর সক্ষম থাকবে, কিংবা এখানকার দীপালিদি রত্নাদিদের মতো ভীমরতি ধরবে না, তদ্দিন তো নতুন বীথিকাটা তার মতো করে বাঁচুক।
সুজাতা আচ্ছন্নের মতো শুনছিল। অস্ফুটে বলল, তুই যে ভাল আছিস সেটা দেখানোর জন্যেই বুঝি আমায় ডাকলি?
না রে, ঠিক তা নয়। মাঝে মাঝে ছোটবেলার বন্ধুদের কথা মনে পড়ে তো, তারা কে কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করে। বীথি নির্মল হাসল, তুই নিশ্চয়ই খারাপ নেই? চাকরিবাকরি করতিস, নিজের একটা পৃথিবী ছিল, ছেলেও তো শুনি খুব বুঝদার...
বুকটা চিনচিন করে উঠল সুজাতার। সত্যি কি তার কোনও আলাদা ভুবন ছিল? আছে? ঘরোয়া গৃহবধূ বীথির সঙ্গে তার যাপিত জীবনে কতটুকুই বা তফাত? বাবুন-রুমা যথেষ্ট ভদ্র শালীন, মাকে খুব অযত্ন করে না, কিন্তু তাতে কি সুজাতার অবস্থানের কিছু অদলবদল ঘটেছে? এই যে হঠাৎ হঠাৎ হৃৎপিণ্ড দুকদুক করে উঠছে, অজান্তেই ঘড়ির কাঁটায় চোখ চলে যাচ্ছে বার বার, এটা কার উৎকণ্ঠা? মাম্পি-ভুতুমের ঠাম্মার? রুমার শাশুড়ির? বাবুনের মায়ের? অন্তত সুজাতার যে নয়, এ তো হলফ করে বলতে পারে সুজাতা।
অঘ্রানের দুপুর কখন বিকেলে মিশে গিয়েছে। একটানা বকবক করেই চলেছে বীথি। মুড়ি চানাচুর মেখে খাওয়াল। শোনাচ্ছে শান্তিনীড়ের আরও অনেকের গল্প। এই বোর্ডার, ওই বোর্ডার, এই দিদি, সেই দিদি...। ছেলেমেয়ে আসে না বলে কে সারাদিন গুমরে গুমরে কাঁদে, কে কবিরাজি কাটলেট কিনে এনে লুকিয়ে লুকিয়ে খায়, কে যেন দিবারাত্র পুজোআর্চা নিয়ে পড়ে আছে, কারা দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যায় কত গল্পই না বলছে রসিয়ে রসিয়ে।
কিছু শুনছিল সুজাতা। কিছু শুনছিল না। কেবলই তার মনে হচ্ছিল, না এলেই বুঝি ভাল হত। না এলেই তো ভাল হত।

ছবি: সুব্রত চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.