ক্লাসঘরের সামনের বারান্দার বেঞ্চিতে চুপ করে বসেছিল মিলিতা। স্কুল আজ ফাঁকা। সকাল থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় জমা জলে মাছ ধরছে কেউ কেউ। বড়দি একটু আগেই ওর কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বলছিলেন, দেখো তো, কতক্ষণ বসে আছ। এখনও তোমার রিকশা এল না। এমন দিনে কেন স্কুলে এলে? জানই তো ‘রেনি ডে’ হবে। ঠিক আছে। বাড়ির নম্বর দাও, তোমার গার্জেনকে নিয়ে যেতে বলি।
দূরের দিদিমণিরা বোধ হয় আসেননি আজ। আশপাশের যাঁরা, কমনরুমে এখনও গল্পগুজব করছেন। উমাদি, মানে যিনি ঘণ্টা দেন, দিদিমণিদের জন্য ঠোঙায় করে বাইরে থেকে তেলেভাজা নিয়ে এলেন। ও একা বসে আছে বলে দিদিমণিরা ওকেও একটা বড় বেগুনি দিয়েছেন। তবে চা খেতে নিশ্চয়ই বলবেন না। ওঁরা তো জানেন না যে, মিলিতার মা রোজ অনেকটা দুধে একটু চা দিয়ে ওকে দুধ-চা করে দেন।
মিলিতা আজ স্কুলে এসেছে বায়না করে। মা বার বার বারণ করছিলেন। তবু যে জন্য ওর স্কুলে আসা সেটাই হল না। প্রিয়াঙ্কা আজও স্কুলে আসেনি। ওর জ্বর কি তা হলে সারেনি এখনও?
|
প্রায় এক সপ্তাহ হল প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে মিলিতার ঝগড়া হয়েছে। তার পর থেকেই কথা বন্ধ। আসলে হয়েছে কী, লিপিকাদির নাটকে প্রিয়াঙ্কা সেজেছিল রাজকুমারী আর মিলিতা ওর সৎমা। সেই হিংসুটে রানি। রানির পাঠানো বিষাক্ত আপেল খেয়ে রাজকুমারী তো অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যাবে আর রানি ভীষণ খুশি হবে। মিলিতা বার বার বলেছিল প্রিয়াঙ্কাকে, আপেলটা পুরো খাস না। একটু রাখিস।
ও মা, পর্দার আড়ালে এসে প্রিয়াঙ্কা বলে কিনা, ও পুরো আপেলটাই খেয়ে নিয়েছে। মিলিতাকে দেওয়ার কথাই মনে নেই। এত রেগে গেছিল মিলিতা, প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে কথাই বলছিল না। ও কি বোঝেনি যে, আপেলটা ভাল খেতে ছিল বলেই প্রিয়াঙ্কা সবটা খেয়ে ফেলেছে। মেয়েটা ভারী অদ্ভুত। সব সময় উল্টোপাল্টা করবে আর মিথ্যে করে বলবে, ভুলে গেছি।
এই যেমন সে দিন ক্লাসটিচার বললেন, ‘মিড ডে মিল’-এ আজ ডিমের ডালনা আর ভাত দেওয়া হবে। কে কে খাবে হাত তোলো। ওরা প্রায় সবাই হাত তুলল। প্রিয়াঙ্কা কোনও সাড়াশব্দ করল না। আসলে অনেকের বাড়ি থেকেই মিড ডে মিল খেতে অনুমতি দেয় না তো। মিলিতার মা টিফিন দিয়ে দেন। আবার বলেন, ইচ্ছে হলে স্কুলেও খাস। বন্ধুদের সঙ্গে খেতে তো ভালই লাগে। প্রিয়াঙ্কা কোনও দিন খায় না। ওর মা’র বারণ আছে। মিলিতা ওকে বলেছিল, ভাল মেনু থাকলে খেয়ে নিবি, কে আর দেখতে আসছে? কিন্তু ডিমের কথা শুনেও হাত তুলল না ও। ও মা, মিলিতা খাবারটা আনার পর ‘একটু দে, একটু দে’ করে কতটা ডিম খেয়ে নিল। এটা কি ঠিক? তুই নিতে পারতিস বাবা!
তার পর টিঙ্কু পালের ব্যাপারটা। সেটাও তো ওর জন্যেই গোলমাল হয়ে গেল। টিঙ্কু এসেছে বর্ধমানের একদম ভেতরের দিকের একটা গ্রাম থেকে। পড়াশোনায় ভীষণ কাঁচা। সিক্সে পড়ে, অথচ রিডিং পড়তেই শেখেনি। স্কুলের নিয়মকানুন কিছু বুঝতেই পারে না। ওকে নিয়ে মিলিতারা খুব মজা করে। পনেরোই অগস্টের আগের দিন ও জিজ্ঞেস করেছিল মিলিতাকে, কাল স্কুলে কি অনুষ্ঠান হবে? মিলিতার মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল, কিছু হবে না তো। বড় দিদিমণি আর ক’জন দিদিমণি এসে পতাকা তুলে দিয়ে চলে যাবেন।
মেয়েরা আসবে না?
না। পনেরোই অগস্ট তো স্কুল বন্ধ থাকে। ছুটি না?
অথচ ওই দিন প্যারেড হয়ে গিয়েছে, প্রায় পনেরো মিনিট পরে, হাঁফাতে হাঁফাতে টিঙ্কু এসে হাজির। ওকে দেখেই মিলিতারা লুকিয়ে পড়েছে। কিন্তু স্কুল থেকে বেরোবার সময় টিঙ্কু ঠিক দেখতে পেয়েছে মিলিতাকে।
তোমরা যে বলল, আজ স্কুল হবে না। ভাগ্যিস নবনীতার মায়ের সঙ্গে দেখা হল! উনি বললেন বলেই স্কুলে এলাম।
মিলিতা তাড়াতাড়ি বলে, তোমাকে বারণ করে আমরা এসেছি কেন, সেটাই জানতে চাও তো? আরে, তুমি তো চলে গেলে, ঠিক তক্ষুনি স্কুল ক্যাপ্টেন নীপাদি এসে বলে গেল, স্কুলে সব স্টুডেন্টদের আসতেই হবে। তোমাকে দেখতে পেলে অবশ্যই জানিয়ে দিতাম। টিঙ্কুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ও, প্রিয়াঙ্কা এক পাশে দাঁড়িয়ে হেসেই চলেছে। অমনি সব বুঝে নিয়ে টিঙ্কু গম্ভীর হয়ে গেল! ও তো মিলিতাকেই মিথ্যেবাদী ভাবল।
সেই থেকে মিলিতা ঠিক করেছিল প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে একদম মিশবে না। একে কি বন্ধুত্ব বলে? কিন্তু দিনের পর দিন প্রিয়াঙ্কা না আসায় ও বেশ বুঝতে পারছে, ওকে ছাড়া মিলিতার একদম চলবে না। তাই তো আজ বৃষ্টিতেও স্কুলে এল। কিন্তু কোথায় কী? একা একা বসে আছে, রিকশাকাকুরও পাত্তা নেই। মিলিতা ভাবছিল দিদিমণিদের কাছ থেকে তেলেভাজা পাওয়া ছাড়া আর কোনও ভাল ঘটনাই ঘটেনি আজ। দিনটা খুব বিশ্রী কাটল।
বৃষ্টিটা আবার জোরে আসছে। মিলিতা খাতা খুলে একটা পাতা ছিঁড়ে লেখে, প্রিয়াঙ্কা, তুই স্কুলে আসছিস না বলে আমার খুব মনখারাপ। শিগ্গির আসবি তো? ইতি, মিলিতা (ক্লাস, সিক্স ‘এ’)।
কাগজটায় নৌকা বানিয়ে ও ভাসিয়ে দিল উঠোনের জমা জলে। ঠিক তার পরেই এলেন মা। বড়দির ফোন পেয়েছেন তা হলে? মায়ের সঙ্গে চলে যেতে যেতে পিছন ফেরে ও। দেখে উঠোনের জমা জলে নৌকোটা হেলেদুলে চলেছে। কেউ তো জানে না, ওটা একটা আস্ত চিঠি বুকে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
দু’দিন পরে স্কুলে এসে মিলিতা অবাক! ওদের বেঞ্চে বসে আছে প্রিয়াঙ্কা। ওকে দেখে একমুখ হাসল মেয়েটা! এটাই স্বভাব ওর। সব সময় হাসে। মিলিতাও হেসে ভাব করে নিল। পর পর চারটে ক্লাস। কথা বলা যায়নি একদম। টিফিনে দু’জনে টিফিনবক্স খুলে লাস্ট বেঞ্চে বসল। মিলিতাও আজ গল্প করবে বলে মিড ডে মিল খেতে যায়নি। প্রিয়াঙ্কা হঠাৎই বলল, তোর চিঠি পেয়ে খুব ভাল লেগেছে।
মিলিতা ভুলেই গিয়েছে চিঠির কথা। বলে, চিঠি? তোকে আবার কখন চিঠি দিলাম?
কেন কাগজের নৌকায়। এই দ্যাখ আমার ব্যাগেই রয়েছে। মিলিতা অবাক! ওমা, সেই চিঠিটা যে। জলে ভিজে অক্ষরগুলো ধেবড়ে আবছা হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁরে, এটা তুই পেলি কী করে? আমি তো জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম।
পেয়েছি। প্রিয়াঙ্কা রহস্যটা বজায় রাখতে চায়।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু কে দিল তোকে?
টিঙ্কু।
মানে?
টিঙ্কু সে-দিন স্কুলের ডেস্কে দুটো বই ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। ছুটির পর নিতে এসে দেখে স্কুল ফাঁকা। সব ঘর বন্ধ। শুধু উঠোনে একা একা ভাসছে এই নৌকোটা। তুলে নিয়ে ভাঁজ খুলতেই তোর চিঠি। সে দিনই চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছে।
মিলিতা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। দুটো চিন্তা ওর মাথায় একই সঙ্গে ঘুরছিল। প্রথমটা হল টিঙ্কুকে আর ঠকাবে না। বরঞ্চ বন্ধু করে নেবে। পরেরটা ওকে সত্যি ভাবাচ্ছে। মা যে বলেন, নিজের মতো কাজ করে যাও, ফল যদি পাওয়ার হয় ঠিক পাবে। কথাটা তা হলে মিথ্যে নয়। |
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |