সংবাদপত্র পড়ার উপর সরকারের ‘খবরদারি’র প্রশ্নে আরও এক ধাপ এগোনোর হুমকি দিয়ে রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারগুলিতে কোন কোন খবরের কাগজ রাখা হবে, তার তালিকা নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের মধ্যেই বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা: “মানুষ কোন কাগজ কিনে পড়বে, সেটা তো আমরা এখনও বলিনি। আগামিদিনে বলব। কারণ বিষয়টা আমাদের বিরুদ্ধে একটা চক্রান্তের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।”
সরকারি গ্রন্থাগারগুলিতে ‘কেনার’ জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া সংবাদপত্রের তালিকায় এ দিন যুক্ত হয়েছে আরও পাঁচটি কাগজ। তার মধ্যে রয়েছে ‘কলম’ নামে একটি বাংলা কাগজ, যা এখনও দৈনিক হিসেবে প্রকাশের অপেক্ষায়। আগের তালিকায় কোনও ইংরেজি কাগজ ছিল না। এ দিন তালিকায় ঢুকেছে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’। আর রাখা হয়েছে বাংলা দৈনিক ‘আজকাল’, নেপালি দৈনিক ‘হিমালয় দর্পণ’ এবং সাঁওতালি ভাষার কাগজ ‘সারসাগুন’। অনেকেরই ধারণা, প্রবল জনমতের চাপে নিজেদের ‘নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি’ প্রমাণ করতে একটি নামী ইংরেজি দৈনিক এবং বাংলা দৈনিককে তালিকায় আনা হল। তবে সর্বাধিক প্রচারিত ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-সহ প্রতিষ্ঠিত অন্য দৈনিকগুলি বাছাই তালিকার বাইরেই রয়েছে।
সরকারি এই বিজ্ঞপ্তির প্রতিবাদে এ দিনই কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি দায়ের করেছেন বাসবী রায়চৌধুরী। আবেদনে বলা হয়েছে, রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তিটি দেশের সংবিধান-বিরোধী। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা, পাবলিক লাইব্রেরি অ্যাক্ট (১৯৭৯) বা লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট রুল এই সব ক’টিরই পরিপন্থী ওই বিজ্ঞপ্তি। এমনকী জরুরি অবস্থার সময়ে সংবাদপত্রের ‘সেন্সর’ চালু হলেও গ্রন্থাগার কোন সংবাদপত্র রাখতে পারবে, তা বলা হয়নি। এই মামলার আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “এ বার রাজ্যে ‘পেড নিউজ’ তৈরির চেষ্টা শুরু হল। বিজ্ঞপ্তিতে যে সব খবরের কাগজের কথা বলা হয়েছে, তা শাসক দল তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ। এক সম্পাদক ও তিন সাংবাদিক তৃণমূলের সাংসদ।” আজ, শুক্রবার প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল ও বিচারপতি সম্বুদ্ধ চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলাটির শুনানি হওয়ার কথা।
এই ভাবে সংবাদপত্র বাছাইয়ের ভিত্তি কী, মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের বক্তব্যের পরেও সেই প্রশ্নে ‘বিভ্রান্তি’ বেড়েছে বই কমেনি। কারণ সোমবার গ্রন্থাগার দফতরের বিশেষ সচিবের দেওয়া প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, কাগজগুলি বাছাই করা হয়েছে পাঠকদের মধ্যে ‘মুক্ত চিন্তার প্রসার’ ঘটানোর উদ্দেশ্যে। বুধবার রাজ্যের তথ্য অধিকর্তা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে জানান, সরকারের আর্থিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে কাগজগুলি বাছা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ‘বাছাই’ করা কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রী আবার জানিয়ে দেন, ‘ছোট ছোট কাগজের পাশে দাঁড়ানো’ তাঁর সরকারের নীতি। সরকারের টাকায় কোন কাগজ কেনা হবে, সেটা সরকারই ঠিক করবে। সেই নীতি মেনেই কাগজ বাছাই করা হয়েছে। সেই সঙ্গেই অবশ্য তাঁর বক্তব্য: গ্রন্থাগার দফতরের বাজেট মাত্র ১৯ কোটি টাকা। এত কম টাকায় সব কাগজ কেনা সম্ভব নয়। তাঁর অভিযোগ, “একটা ছোট্ট বিষয়। ছোট্ট ডিপার্টমেন্টের ছোট্ট সার্কুলার। তাই নিয়ে কোনও কোনও মহল নোংরা খেলায় নেমেছে।” কোনও স্বাধীন সংবাদপত্রকে এই ভাবে ‘সাহায্য’ করা সরকারের কাজ কি না, সেই প্রশ্নে এ দিন জবাব এড়িয়ে যান গ্রন্থাগারমন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরী। কিন্তু সেই ‘সাহায্য’ করার দাবিও কতটা ঠিক, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তাঁরই দফতরের জারি করা আর এক নির্দেশে। বৃহস্পতিবার রাজ্যের তথ্য অধিকর্তা বিভিন্ন জেলার তথ্য আধিকারিকদের কাছে পাঠানো নির্দেশে বলেছেন, জেলা স্তরে স্থানীয় ছোট ছোট পত্রপত্রিকাকে সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ থাকবে।
গ্রন্থাগার-বিতর্কে বৃহস্পতিবার উত্তাল ছিল বিধানসভা। এ নিয়ে বামেদের আনা মুলতুবি প্রস্তাব স্পিকার খারিজ করে দেওয়ায় ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। চলে পোস্টার নিয়ে মুহুর্মুহু স্লোগানও। কেন তাঁদের বলতে দেওয়া হচ্ছে না, তা স্পিকারের কাছে জানতে চান বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এর পরেই বিরোধীরা সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান। সন্ধ্যায় সূর্যকান্তবাবুর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের এক প্রতিনিধিদল রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে দেখা করে বলে, গ্রন্থাগারে কোন সংবাদপত্র রাখা হবে, তা নিয়ে সরকারি নির্দেশে রাজ্যের প্রধান বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রগুলির নাম নেই। কিন্তু তৃণমূলের সমর্থনে রাজ্যসভায় নির্বাচিত চার জন সম্পাদকের সংবাদপত্রের নাম সেই তালিকায় আছে।
তার আগে বিধানসভার বাইরে সাংবাদিক সম্মেলন করে সূর্যকান্তবাবু অভিযোগ করেন, বিধানসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার পর থেকেই তাঁরা নানা বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু বলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, “এটা অগণতান্ত্রিক। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক আইন লঙ্ঘন করছে। গ্রন্থাগার বিভাগের নজিরবিহীন সার্কুলারের প্রতিবাদে আমাদের বিধায়কের আনা মুলতুবি প্রস্তাব স্পিকার খারিজ করে দিলেন। এর প্রতিবাদে আমরা ওয়াকআউট করতে বাধ্য হয়েছি।” জরুরি অবস্থার সময়েও এমন হয়নি বলে অভিযোগ করে সূর্যকান্তবাবু বলেন, “এটা মেনে নেওয়া যায় না। ‘মুক্ত চিন্তা’র নামে যা বলা হচ্ছে, তা অন্য সংবাদমাধ্যমকে অপমান করার সামিল। এমন আগে কখনও হয়নি। তাই বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে আমরা বিক্ষোভ দেখিয়েছি।”
সিপিএম বিধায়ক আনিসুর রহমানও গোটা বিষয়টিকে ‘গণতন্ত্র বিরোধী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই বিষয়ে বিবৃতি দিন। তিনি দেননি। যে মন্ত্রী এটা ঘটালেন, তিনি বিধানসভাতেই এলেন না। জানানো হল, তিনি অসুস্থ। অথচ বুধবারই তিনি মহাকরণে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।” গলায় সংক্রমণ হয়েছে বলে জানানোয় এ দিনই বিধানসভার স্পিকার গ্রন্থাগারমন্ত্রী করিম চৌধুরীর তিন দিনের ছুটি ‘অনুমোদন’ করেন।
সংবাদপত্র নিয়ে বিতর্ক দ্বিতীয়ার্ধেও গড়ায়। অর্থমন্ত্রীর অতিরিক্ত ব্যয়বরাদ্দের দাবি সংক্রান্ত বিতর্ক চলাকালীন সরকার পক্ষের উদ্দেশে আনিসুর বলেন, “সংবিধানের কোন ধারায় লেখা আছে এই কাগজটা পড়তে হবে, আর এইটা পড়তে হবে না?” তাঁর দলের মুখপত্রের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, “(ওই কাগজের) নামে বলতে পারেন কেউ পড়বে না। বলতেই পারেন। কিন্তু আনন্দবাজার, টেলিগ্রাফ, বর্তমান ইত্যাদি পড়া যাবে না বলে দিলেন!” আনিসুর সংবাদপত্রের বিষয়ে বলার সময় এ দিন সরকার পক্ষ থেকে প্রতিবাদ শোনা যায়নি। আনিসুর বলেন, “করিম চৌধুরী (গ্রন্থাগারমন্ত্রী) এ রকম করতেই পারেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এতে সায় দিতে পারেন, বিশ্বাস করতে পারছি না। যাঁরা ছাড় পেয়েছেন, তাঁরা ভাববেন না যে নিরাপদ রয়েছেন। ইতিহাস বলছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও এমন ঘটবে।” এ দিনও বিরোধীরা গলায় বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে এসেছিলেন। কোনওটায় লেখা “তোমায় বলে সংবাদপত্র পড়ব না”, কোনওটায় “সংবাদপত্রের উপর নগ্ন আক্রমণ বন্ধ করো” ইত্যাদি।
দলীয় কর্মসূচি অনুযায়ী সংবাদপত্র নিয়ে সরকারি ফতোয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এ দিন মিছিল করেন দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস ও যুব কংগ্রেস কর্মীরা। টালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে হাজরা মোড় পর্যন্ত মিছিল হয়। এ দিনই বিধানসভার বাইরে সাংবাদিক সম্মেলনে সেচ ও জলপথমন্ত্রী মানস ভুঁইঞার কাছে ওই নির্দেশিকা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “আমি এক জন ক্যাবিনেট মন্ত্রী। এক দফতরের মন্ত্রী হয়ে অন্য দফতরের মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করব না। প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে আমাকে প্রশ্ন করুন, উত্তর দেব। তবে পাঠক হিসেবে আমি সব সংবাদপত্রই পড়ি। পড়ে ‘এনজয়’ও করি।” সরকারি নির্দেশ বাতিলের দাবিতে গ্রন্থাগারমন্ত্রীর জেলা উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে জেলা গ্রন্থাগারের সামনে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ দেখায় এসএফআই এবং ডিওয়াইএফ। বহুল প্রচারিত যে সমস্ত বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রের নাম সরকারি তালিকায় নেই, সেগুলি গায়ে সাঁটিয়ে তাঁরা বিক্ষোভ দেখান। জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক মনোঞ্জয় রায় জানান, “আন্দোলনকারীদের দাবি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
রাজনৈতিক প্রতিবাদের পাশাপাশি দৃঢ় হচ্ছে জনমতও। শিলিগুড়ির অতিরিক্ত গ্রন্থাগারের পাঠকদের একাংশ বাড়তি চাঁদা দিয়েও বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলি কেনার প্রস্তাব কর্তৃপক্ষকে দিয়েছেন। জলপাইগুড়ি জেলা গ্রন্থাগারের পরিচালন সমিতির সদস্যরা নিজেরা অর্থ দিয়েই বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র গ্রন্থাগারে রাখবেন বলে প্রাথমিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পুরুলিয়ায় জেলা গ্রন্থাগার-সহ কয়েকটি এলাকায় কয়েক জন ক্ষুব্ধ পাঠক নিজেরাই বাড়তি অন্তত দু’টি কাগজ কেনার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। সমালোচনায় মুখর রয়েছেন বিশিষ্ট জনেরাও। শঙ্খ ঘোষ মনে করেন, এই প্রবণতা ‘বিপজ্জনক’ এবং রাজ্যবাসীর পক্ষে ‘অমঙ্গলের।’ সুকুমারী ভট্টাচার্যের মন্তব্য: “পশ্চিমবঙ্গবাসী এই নির্দেশের দ্বারা অপমানিত, অবহেলিত ও উপেক্ষিত।” |