হাত দু’টো রক্তে ভেজা। কোলে ছেলের নিথর দেহ। এক মুহূর্তের এ দিক-ও দিক। ঘোলার যোগেন্দ্রনগর পেয়ারাবাগানের সবিতা পাল স্পষ্ট মনে করতে পারছেন, বৃহস্পতিবার সকাল সওয়া ছ’টায় ছেলের স্কুল বাসে পাড়ার মোড় থেকে উঠেছিলেন। তাঁর একমাত্র ছেলে শৌভিক (৯) অঙ্ক ভয় পেত। এ দিন ছিল স্কুলে অঙ্ক পরীক্ষা।
|
শৌভিক পাল |
বাসে উঠে চালকের পিছনের আসনে জানলার ধারে মায়ের হাত আঁকড়ে বসেছিল সে। নিজের হাত দু’টো মুখের সামনে তুলে ধরে বলে যাচ্ছিলেন সবিতাদেবী, ‘‘ও আমার গা ঘেঁষে বসেছিল। ওকে বললাম, বাবা, পরীক্ষার জন্য সব নিয়েছো তো? ও বলল, হ্যা। তার পরেই প্রচণ্ড একটা শব্দ। দৈত্যের মতো আছড়ে পড়া লরিটা।’’
বৃহস্পতিবার, কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে এবং সোদপুর-মধ্যমগ্রাম রোডের সংযোগস্থলে ঘটে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। পুলিশ জানিয়েছে, ব্যারাকপুর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন বিদ্যাভবনের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল শৌভিক পাল। রোজ যাতায়াত করত স্কুলবাসেই। অন্য দিন পাড়ার মোড় থেকে মা’ই বাসে তুলে দেন। এখন পরীক্ষা চলছে বলে ছেলেকে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছিলেন। শৌভিকের বাবা স্বপনবাবু কল সারান। রোজকার মতো এ দিনও সকাল ছ’টা দশ মিনিটে মায়ের সঙ্গে বাসে উঠেছিল শৌভিক। চালকের পিছনের আসনে জানলার ধরে বসেছিল। পাশে মা সবিতাদেবী। |
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, একশো মিটার মতো এগিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের চৌমাথার কাছে বাসটি সোদপুরের দিকে ঘোরার জন্য গতি কমায়। আচমকাই উল্টো দিক থেকে তীব্র গতিতে আসা একটি লরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চালকের পিছনে বিপদকালীন দরজায় সজোরে ধাক্কা মারে। ওই দরজা লাগোয়া আসনটিতেই বসেছিল শৌভিক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় মায়ের কোলে। দুর্ঘটনায় জখম হয় অরিন্দম বিশ্বাস নামে শৌভিকের এক সহপাঠী ও বিশ্বরূপ ভৌমিক নামে পঞ্চম শ্রেণির আর এক ছাত্র। জখম হন বাসচালকও।
ট্রাকটি স্কুল বাসে ধাক্কা মারার পরে রাস্তার ধারের একটি দোকানে ধাক্কা মারে। দোকান-মালিক দ্বিজেন শিকদার, তাঁর স্ত্রী শেফালিদেবী এবং দোকানের এক কর্মচারী কোনও রকমে প্রাণে বাঁচেন। ট্রাকচালক পালায়। বাসটি যে পরিবহণ সংস্থার, সেই সংস্থার পক্ষ থেকে অন্য একটি বাসে বাকি ছাত্রদের তোলা হয়। ব্যারাকপুর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন বিদ্যাভবনের প্রাতঃবিভাগের অধ্যক্ষ শঙ্কর মহারাজ বলেন, ‘‘আমাদের প্রথম সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা শুরু হয়েছে। শৌভিক ও জখম দুই ছাত্র ছাড়া বাকিরা এ দিন পরীক্ষা দিয়েছে। শৌভিকের ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। কিন্তু এই বাসগুলি স্কুল চালায় না। অভিভাবকেরাই ভাড়া করেন। তাই স্কুলের কোনও দায় নেই। তবু আমরা সহানুভূতি জানাতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম।’’ ট্রাফিক ব্যবস্থার দিকেই আঙুল তুলেছেন বাসিন্দারা। অভিযোগ, কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে সোদপুর-মধ্যমগ্রাম চৌমাথায় ট্রাফিক সিগন্যাল থাকলেও তা কাজ করে না। ভোরে চৌমাথার দু’ধারে সার দিয়ে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকায় উল্টো দিক থেকে আসা গাড়িও অনেক সময়ে নজরে পড়ে না। পুলিশের সামনেই বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা। ব্যারাকপুরের ডিসি (সদর) কল্লোল গনাই বলেন, “আমরা অবিলম্বে ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নতি করার চেষ্টা করছি।” |