নানা চাপ সত্ত্বেও ধর্ষণের অভিযোগ প্রত্যাহার করতে রাজি হননি হতদরিদ্র পরিবারের এক বধূ ও তাঁর আত্মীয়স্বজন। ওই বধূর ভ্রাতৃবধূর কোলের ছেলে অপহৃত হওয়ার পরেও বারেবারে পুলিশ-প্রশাসন, নেতা-কর্তাদের একাংশের দ্বারস্থ হয়েও ‘পরামর্শ’ ছাড়া কিছু পাননি। তা সত্ত্বেও এই পরিবার দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছিলেন। কিন্তু, মঙ্গলবার এলাকার গম খেত থেকে মাটি খুঁড়ে দুধের শিশুটির দেহ উদ্ধারের পরে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপোখর থানার সাতমারা গ্রামের ওই পরিবার।
এতটাই অসহায় বোধ করছে পরিবারটি যে, সদ্য সন্তান হারানো প্রমীলা রায় কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “সুবিচারের আশায় সব সহ্য করেছি। কিন্তু দুধের বাচ্চাটাকে যে ভাবে মরতে হল, তারপরে সমাজের কার উপরে ভরসা করব? অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবছি আমরা।” প্রমীলাদেবীর স্বামী গণেশ রায় এই দিনই অন্তর্বর্তী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
এই ঘটনায় বাসিন্দাদের মধ্যেও ক্ষোভ দানা বাঁধছে। স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতি কংগ্রেসের দখলে। সাংসদ কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি। বিধায়ক কংগ্রেসের গোলাম রব্বানি। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের একাংশের সঙ্গে আঁতাঁতের জেরে পুলিশ পক্ষপাতমূলক আচরণ করায় অভিযুক্তরা বেপরোয়া হয়েছে। |
কংগ্রেস নেতারা অবশ্য সে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁদের তরফে কোনও গাফিলতি নেই বলে দাবি করেছেন স্থানীয় পুলিশ কর্তারাও। তবে রাজ্য পুলিশের উত্তরবঙ্গের আইজি সঞ্জয় সিংহ বলেন, “অভিযোগ গুরুতর। এসপিকে বলেছি, নিজে তদন্ত করে চটজলদি রিপোর্ট দিন। তার পরে রিপোর্ট দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেব। বাসিন্দাদের দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই।”
প্রায় ৫ মাস ধরে ঠিক কী ঘটেছে গোয়ালপোখরের ওই গ্রামে? গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সন্ধ্যাবেলায় মাঠে গরু আনতে গিয়ে প্রমীলাদেবীর ননদ গণধর্ষণের শিকার হন বলে অভিযোগ। অভিযুক্ত ৬ জনই তাঁদের প্রতিবেশী। তাঁদের নাম পরশ রায়, সুমন্ত রায়, হেমন্ত রায়, নরেশ রায়, বাবলু রায় ও রবিন রায়। এঁদের মধ্যে পরশবাবু এলাকার কংগ্রেস নেতা হিসেবে পরিচিত। পুলিশ পরে পরশবাবু-সহ দু’জনকে গ্রেফতার করেন। পরে তিনি জামিনও পান।
এর পরেই প্রমীলাদেবীদের উপরে চাপ বাড়ে। প্রমীলাদেবীর অভিযোগ, “ধর্ষণের ঘটনার তদন্তের নামে পুলিশ কয়েকদিন বাড়িতে এসে ঝামেলায় না-গিয়ে মিটমাট করে নেওয়ার উপদেশ দিল। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সহ আরও কয়েকজন নেতার কাছে বলেছিলাম। সকলেই মামলা তোলার পরামর্শ দেন।” তিনি বলেন, “পুলিশই যখন মামলা তুলতে বলছে, তখন আর কার কাছে অভিযোগ করতে যাব?”
গত ১১ মার্চ সন্ধ্যায় প্রমীলাদেবীদের বাড়িতে গিয়ে পরশবাবুরা ফের মামলা তোলার জন্য চাপ দিতে শুরু করলে বচসা শুরু হয় বাঁধে বলে অভিযোগ। সেখান থেকে শুরু হয় সংঘর্ষ। জখম হন পরশবাবু ও গণেশবাবু। ইতিমধ্যে প্রমীলাদেবী দেখেন, দেড় বছরের ছেলে বিক্রম দাওয়ায় বসে ছিল। সে নেই।
প্রমীলাদেবীর অভিযোগ, “রাতে আমার স্বামী গোয়ালপোখর থানায় গেলে ওঁকে ধরে রাখা হয়। পরদিন গাঁয়ের লোকজনদের নিয়ে আমি থানায় গেলে বাচ্চাকে অপহরণের অভিযোগ নেওয়া হয়। কিন্তু, পুলিশ তখন আমার ননদই ছেলেকে লুকিয়ে রেখেছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। আরও দু’জনকে তারা ধরেছে। তবে তাদের ভাল করে জেরা করা হলে হয়তো ছেলেটাকে জীবিত পেতাম।”
কী বলছেন নেতা-কর্তারা ও পুলিশ-প্রশাসন? গোয়ালপোখর (১) পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তথা কংগ্রেস নেত্রী অনিতা পাল বলেন, “পরশবাবু আমাদের দলের কর্মী। ওঁদের ফাঁসানোর চেষ্টা করায় গাঁয়ের লোকজন অনেকেই বিরক্ত। তবে তার জেরে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকলে দুঃখজনক। গোলমালের সময়ে কে যে বাচ্চাটাকে সরিয়ে ফেলেছিল সেটা পুলিশ দেখুক।” গোয়ালপোখরের কংগ্রেস বিধায়ক গোলাম রব্বানি জানান, তাঁদের দলের তরফে চাপ দেওয়ার কথা ভিত্তিহীন।
ইসলামপুরের এসডিপিও নীলকান্ত সুধীর কুমার বলেন, “পুলিশের তরফে কোনও গাফিলতি নেই। ধর্ষণের মামলায় আগেই দু’জন গ্রেফতারও হয়েছে। বাকিদের ধরা যায়নি। গণেশবাবুকে গ্রেফতার করার পরে তাঁর স্ত্রী শিশু অপরণের অভিযোগ জমা দিয়েছেন। পাশাপাশি, শিশুটিকে খুনের ঘটনায় যে ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, তার মধ্যে দু’জনকে ধরা হয়েছে। অন্যদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। একজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন থাকায় নজরদারি রাখা হয়েছে। পুলিশের তরফে কোনও গাফিলতি নেই।”
উত্তর দিনাজপুর জেলা বামফ্রন্টের সচিব তথা সিপিএমের উত্তর দিনাজপুর জেলা সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য অপূর্ব পাল অভিযোগ করেন, “আগে কেন শিশুটিকে উদ্ধার করা গেল না? শিশু অপহরণ ও খুনের ঘটনায় সমস্ত অভিযুক্তকে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে গ্রেফতার করা না হলে আমরা গোয়ালপোখর থানা ঘেরাও করে লাগাতার আন্দোলনে করব।”
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রদেশের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক তথা উত্তর দিনাজপুরের প্রাক্তন সভাপতি অসীম ঘোষ জানান, পুলিশের তরফে গাফিলতি প্রমাণ হলে তাঁরাও কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাজ্য সরকারকে জানাবেন। |