দুপুরে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ঘণ্টাখানেক বৈঠক করে বেরিয়ে রাজ্যের গ্রন্থাগারমন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরী দাবি করলেন, “মুখ্যমন্ত্রী সব শুনে বলেছেন, এটা আমাদের পলিসিতেই (নীতি) আছে। যা হয়েছে তা সরকারি নীতি মেনেই। ইউ হ্যাভ ডান ইট। ওয়েল ডান।” রাতে মহাকরণ ছাড়ার আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং জানিয়ে গেলেন, “কোনও ডিসপিউট (বিতর্ক) নেই। ডিসপিউট তৈরি করছে আপনাদের কাগজ (আনন্দবাজার)।”
রাজ্যের সরকারি ও অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারগুলিতে বাছাই করা আটটি ‘অনুগত’ খবরের কাগজ রাখা নিয়ে সরকারের অনমনীয় মনোভাব এ ভাবেই বুধবার আরও স্পষ্ট হল। নির্দেশ অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার হুমকিও শুনিয়েছেন বিভাগীয় মন্ত্রী।
জনশিক্ষা ও গ্রন্থাগার দফতরের বিশেষ সচিবের দেওয়া ওই সার্কুলার নিয়ে সোমবার থেকেই আলোড়ন শুরু হয়েছে। এমন একটি নির্দেশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ মানুষ, বিশিষ্ট জন, রাজনীতিক সকলেই। কিন্তু সর্বাধিক প্রচারিত আনন্দবাজার পত্রিকা, ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ-সহ অন্য সব প্রতিষ্ঠিত দৈনিক সংবাদপত্রকে বাদ দিয়ে কেন সরকার তথা প্রধান শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ‘সমর্থক’ ও ‘অনুগত’ বলে পরিচিত পাঁচটি বাংলা, দু’টি উর্দু ও একটি হিন্দি সংবাদপত্রই শুধু সরকারি গ্রন্থাগারগুলিতে রাখা যাবে, তার ‘যুক্তিগ্রাহ্য’ ব্যাখ্যা এখনও মেলেনি। সরকারি নির্দেশে এটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘রাখার যোগ্য’ যে আটটি সংবাদপত্রের নাম তাদের তালিকায় রয়েছে, তার বাইরে সব সংবাদপত্রকেই ‘রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত’ এবং ‘মুক্ত চিন্তা’র পরিপন্থী বলে মনে করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। অথচ বুধবার রাতে রাজ্যের তথ্য অধিকর্তা উমাপদ চট্টোপাধ্যায় জানান, সরকারের ‘আর্থিক অবস্থা’ বিবেচনা করেই ওই আটটি সংবাদপত্রকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের কোনও যোগ নেই, সে কথাও জোর দিয়ে বলেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, “এই নির্দেশ গ্রন্থাগার দফতরের। বিশদ ব্যাখ্যা তারাই দিতে পারবে।” |
যদিও মহাকরণের অন্দরে খবর, বিধানসভা অধিবেশন শুরুর আগে তৃণমূলের মন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের দিন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই গ্রন্থাগারমন্ত্রীর কাছে সংশ্লিষ্ট আটটি সংবাদপত্রের নাম করে ইঙ্গিত দেন, ওই আটটি ছাড়া বাকি খবরের কাগজগুলি সব সময়ে ‘সরকার-বিরোধী’ মনোভাব নিয়ে চলে। সেই মতো খবর প্রকাশ করে। তাই সরকারি গ্রন্থাগারগুলিতে ওই আটটি সংবাদপত্র ছাড়া আর কোনও সংবাদপত্র রাখার দরকার নেই। অনেকের ধারণা, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই গ্রন্থাগার দফতর সার্কুলার দিয়ে জানিয়ে দেয়, ‘মুক্ত চিন্তা’র প্রসার ঘটাতে বাংলা দৈনিক ‘সংবাদ প্রতিদিন’, ‘সকালবেলা’, ‘একদিন’, ‘খবর ৩৬৫ দিন’, ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’, হিন্দি দৈনিক ‘সন্মার্গ’ এবং উর্দু দৈনিক ‘আখবর-ই-মশরিক’ ও ‘আজাদ হিন্দ’ ছাড়া আর কোনও সংবাদপত্র রাখা যাবে না।
মঙ্গলবার অবশ্য মহাকরণের একটি সূত্রে খবর ছিল, এই ধরনের ‘লিখিত নির্দেশ’ কেন বেরোল, তা জানতে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়েছে। তথ্য দফতরকে বিষয়টি জানতে বলা হয়েছে। তাই বুধবার দুপুরে যখন বিভাগের সচিব রিনচেন টেম্পোকে নিয়ে আবদুল করিম চৌধুরীকে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে ঢুকতে দেখা যায়, তখন মহাকরণের বিভিন্ন মহলে কৌতূহল বাড়ে। নানা জল্পনা আরম্ভ হয়। মুখ্যমন্ত্রী কী নির্দেশ দেন, তা নিয়ে শুরু হয় প্রতীক্ষা।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে পৌনে এক ঘণ্টা কথা বলে বেরিয়ে এসে করিম চৌধুরী বলেন, তিনি যা করেছেন সরকারি নীতি মেনেই করেছেন এবং মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী কি তাঁকে ওই বিজ্ঞপ্তির ব্যাপারেই ডেকে পাঠিয়েছিলেন? করিম সাহেব বলেন, “রাজ্যের কোথায় কোথায় কত লাইব্রেরি আছে, আর কোথায় কোথায় করা যায়, সে সব নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে।” বিজ্ঞপ্তি নিয়ে কী কথা হল? গ্রন্থাগারমন্ত্রী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীকে সব বলেছি। তিনি শুনে সন্তুষ্ট।”
সরকারি নির্দেশের ব্যাখ্যা দিয়ে মন্ত্রী জানান, ওই আটটি সংবাদপত্র ছাড়া বাকি সবাই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে চলে। তাই সরকারি টাকায় ওই আটটি কাগজের বাইরে অন্য কোনও কাগজ কিনে তা সরকারি ও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে রাখা যাবে না। বিজ্ঞপ্তিতেও এই কথাটি খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা এ দিন এ কথা প্রচার করার চেষ্টা করেছেন যে, সরকারি নির্দেশে কোথাও আটটি কাগজের বাইরে অন্য কাগজ কেনা যাবে না, তা বলা নেই।
এ দিকে, গ্রন্থাগার দফতরের এই নির্দেশ নিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে সরকারের শরিক কংগ্রেস। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “বেশি প্রচারিত কাগজ মানেই মানুষ তা পড়ে। সরকার চাপ দিয়ে সেই সব কাগজ পড়া তো বন্ধ করতে পারবে না! আর এই ধরনের নির্দেশে মুক্ত চিন্তার প্রসার ঘটতে পারে না। এ সব অবরুদ্ধ চিন্তাধারা। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই কংগ্রেস কর্মীদের জেলায় জেলায় আন্দোলনে নামতে বলেছি।” কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, “এই ধরনের নির্দেশ বিপজ্জনক। এটা মননের নৈরাজ্য (অ্যাকাডেমিক অ্যানার্কি)। আমরা তাড়াতে চেয়েছিলাম হার্মাদ। কিন্তু নিয়ে এলাম উন্মাদ।” এসইউসি সাংসদ তরুণ মণ্ডলও বলেন, “এই সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের পরিপন্থী।” বিজেপি সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার পাশাপাশি বলেছে, “সিপিএম ও কংগ্রেসও একই কাজ করেছিল। তাই ওদের এই বিষয়ে প্রতিবাদ করার নৈতিক অধিকার নেই।” |