সরকার বনাম সেনাধ্যক্ষের সংঘাত নতুন মোড় নিল। দেশের তিনটি সামরিক বাহিনীর ‘দুর্দশার’ কথা জানিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে লেখা সেনাধ্যক্ষের চিঠি ফাঁস নিয়ে আজ ফের তোলপাড় হল সারা দেশ। দফায় দফায় মুলতুবি হল সংসদ। চিনের প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও-সহ চার রাষ্ট্রপ্রধান দিল্লিতে উপস্থিত থাকাকালীন এই বিতর্কে প্রবল অস্বস্তিতে পড়েছে মনমোহন-সরকার।
ঘুষ-বিতর্কে নিষ্ক্রিয়তার দায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি গত কালই চাপিয়েছিলেন সেনাপ্রধানের উপর। তার পরেই আজ সংবাদমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে সেনাপ্রধান বিজয় কুমার সিংহের ১২ মার্চে লেখা চিঠি ফাঁস হয়ে যায়। সেই চিঠিতে সেনাপ্রধান লিখেছেন, স্থল, বায়ু এবং নৌ-এই তিন বাহিনীর অবস্থাই সঙ্গিন। শত্রুট্যাঙ্ককে পরাজিত করার মতো গোলাবারুদই ভারতীয় ট্যাঙ্কের নেই। বায়ুপ্রতিরক্ষাব্যবস্থার ৯৭ শতাংশ সরঞ্জামই ‘মান্ধাতার আমলের’। এই হাল শুধরোতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে ‘উপযুক্ত নির্দেশ’ দেওয়ারও অনুরোধ করেছেন তিনি।
প্রথমে সেনাপ্রধানের বয়স নিয়ে বিতর্ক, তারপরে তাঁকে ঘুষ দিতে চাওয়ার অভিযোগের পর এ বার দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার হাঁড়ির হাল বের হয়ে পড়ায় নতুন করে অস্বস্তিতে পড়েছে মনমোহন-সরকার। এমন একটা দিনে যখন এই ঘটনা ঘটেছে, যখন ব্রিকস-সম্মেলনের জন্য চিন, রাশিয়া-সহ চারটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের প্রধান দিল্লিতে এসে পৌঁছেছেন। বিশেষ করে চিনের প্রেসিডেন্টের ভারতে থাকাকালীন এই বিতর্ক নয়াদিল্লির কাছে একেবারেই অনভিপ্রেত। তাই সরকারের তরফে বারবার বোঝানো হচ্ছে, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে প্রকাশ্যে বিতর্ক হওয়া উচিত নয়। কিন্তু বিরোধীরা মনমোহন-সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রকৃত হাল কী, তা নিয়েও সরকারের ব্যাখ্যা চাইছেন তাঁরা। আরজেডি, সমাজবাদী পার্টি, বিজেডি-র মতো আঞ্চলিক দলের নেতারা দাবি তুলেছেন, অবিলম্বে সেনাপ্রধানকে বরখাস্ত করা হোক। কারণ তিনিই এই চিঠি ফাঁস করেছেন বলে তাঁদের অভিযোগ। দু’দিনের সফরে সেনাধ্যক্ষ এ দিন কাশ্মীরে গিয়েছেন। এখনও প্রকাশ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি তিনি। এই পরিস্থিতিতে কী করতে পারে মনমোহন-সরকার? |
কংগ্রেস নেতাদের মধ্যেও অনেকে মনে করছেন, সেনাধ্যক্ষকে বরখাস্ত করা উচিত। ঠিক যে ভাবে অতীতে নৌসেনাপ্রধান বিষ্ণু ভাগবতকেও বরখাস্ত করা হয়েছিল। জেনারেল ভি কে সিংহ প্রথমে প্রোটোকল ভেঙে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বদলে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। তারপরে সরকারকে প্যাঁচে ফেলতে তিনি সেই চিঠি ‘ফাঁস’ করে দিয়েছেন। কারণ বয়স-বিতর্কে সেনাপ্রধানের দাবি মেনে তাঁর মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভায়লার রবি তারই ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, “সেনাধ্যক্ষ যা করছেন, তা এক জন হতাশ লোকের কাজ। কারণ আদালতে গিয়েও তিনি তাঁর চাকরির মেয়াদ বাড়াতে পারেননি।” দলের তরফে অবশ্য অন্য কংগ্রেস নেতাদের সংযত থাকতে বলা হচ্ছে। কারণ সরকার তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব মনে করছে, দিল্লিতে অন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের হাজির থাকাকালীন এই বিতর্ক ঠিক নয়। যদি তাঁকে বরখাস্ত করারও সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তা হলে তা সম্মেলনের পরেই নিতে হবে। সরকারের মধ্যে আরেকটি মত হল, জেনারেল ভি কে সিংহ ব্যক্তিগত ভাবে সৎ। এমনিতেই তিনি ৩১ মে অবসর নেবেন। আর কোনও সমস্যা তৈরি না করলে তার আগে তাঁকে বরখাস্ত করার পথে না হাঁটাই ভাল। কারণ জেনারেল ভি কে সিংহের তূণে সরকারের বিরুদ্ধে আর কী কী তির রয়েছে, সেটাও সরকারের জানা নেই। আজ চিঠি ফাঁস হওয়ার পরেই অ্যান্টনি মনমোহন সিংহের সঙ্গে বৈঠক করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম এবং প্রতিরক্ষা সচিব শশীকান্ত শর্মাও সেখানে ছিলেন। কাল কংগ্রেসের কোর গ্রুপের বৈঠকেও এ বিষয়ে কথা হবে। দেশের স্বার্থে একে রাজনৈতিক তরজার বিষয় না করে সহযোগিতা করার জন্যও বিরোধী দলগুলির কাছে বার্তা পাঠাচ্ছে কংগ্রেস।
বিজেপি কিন্তু মনমোহন-সরকারের ‘রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অভাব’ ও ‘সিদ্ধান্তহীনতা’ নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অতিরিক্ত খুঁতখুঁতানির জন্য দেশের অস্ত্র এবং প্রতিরক্ষাসরঞ্জাম কেনা ব্যাহত হচ্ছে বলে গতকালই বিজেপির তরফে কটাক্ষ করা হয়েছিল। আজ সেনাধ্যক্ষের চিঠিকে অস্ত্র করে সরাসরি সেই অভিযোগ তুলেছেন সুষমা স্বরাজ। তিনি বলেন, “সেনাবাহিনীর কাছে দেশের সুরক্ষার জন্য অস্ত্রশস্ত্রই নেই জেনে তো সাধারণ মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়বেন।” পাশাপাশি, এমন গোপন চিঠি ফাঁস হল কী করে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে বিরোধীদের দাবি, এর জবাব সরকারকে দিতে হবে এবং যারা এই ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার বারবার বলছে, বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা হওয়া উচিত নয়। তা হলে সরকার এগুলো বন্ধ করার জন্য কী করছে? প্রশ্নের মুখে অ্যান্টনি রাজ্যসভায় বলেন, “প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার পরে আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।” সেনাধ্যক্ষ যে ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন তা মেনে নিয়ে তিনি বলেন, এ নিয়ে প্রকাশ্য বিতর্ক হওয়া উচিত নয়। তাঁর কটাক্ষ, সরকারের মধ্যে গোপন বার্তা বিনিময় ফাঁস করে দেশের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা যায় না। লালুপ্রসাদের মতো অনেকেই আবার সেনাপ্রধানকে আক্রমণ করে প্রশ্ন তুলেছেন, গোলাবারুদ না থাকলে সেনাধ্যক্ষ এত দিন কেন চুপ করেছিলেন? তিনি বোধহয় এর পর ভোটে দাঁড়াবেন। তাঁকে অবিলম্বে বরখাস্ত করা উচিত। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী পল্লম রাজু অবশ্য মানছেন, “সুরক্ষা ব্যবস্থায় ফাঁক রয়েছে এবং কেন্দ্র গুরুত্ব দিয়ে তা বিবেচনা করছে। সমরাস্ত্র কেনার প্রক্রিয়াও দ্রুততর করার চেষ্টা হচ্ছে।”
সরকারের সঙ্গে সেনাপ্রধান বিজয় কুমার সিংহের সংঘাতের প্রথম পর্ব শুরু হয় বয়স-বিতর্ক দিয়ে। তাঁর বয়স এক বছর কম বলে সেনাপ্রধান যে দাবি করেন, শেষ পর্যন্ত তা ধোপে টেকেনি। এরপর সেনাধ্যক্ষ জানান, গত বছর নিম্ন মানের ট্যাঙ্ক কেনার জন্য তাঁকে ১৪ কোটি টাকা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন এক প্রাক্তন সেনা অফিসার। তিনি বিষয়টি অ্যান্টনিকে সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়েছিলেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী কেন কিছু করেননি, সে প্রশ্ন ওঠায় নিজের দায় এড়িয়ে গতকাল অ্যান্টনি জানিয়েছিলেন, সেনাধ্যক্ষই তখন ব্যবস্থা নিতে চাননি। তার পরেই আজকের চিঠি ফাঁস! ঘুষ-বিতর্কে অবশ্য ইতিমধ্যেই সিবিআই-তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিবিআই সূত্রের খবর, সেনাধ্যক্ষ ৩০ মার্চের মধ্যে লিখিত অভিযোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন। ঘুষ দিতে চাওয়ার অভিযোগ প্রমাণে তাঁর কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে বলেও জানিয়েছেন সেনাধ্যক্ষ। |