স্কুলে যাওয়ার পথে বন্ধুর মুখেই প্রথম খবরটা শোনে টুম্পা। বন্ধুরা তাকে ঘিরে হাসি-ঠাট্টাও শুরু করে। তার যে বিয়ে!
কিন্তু কথাটা গোড়ায় বিশ্বাসই করতে চায়নি মুর্শিদাবাদের সুতির অরঙ্গাবাদ বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ওই ছাত্রী। বাড়িতে এর আগেও তার বিয়ের কথা উঠেছিল। তখন সে বলেছিল, বিয়ে না করে পড়াশোনা করতে চায়। সে কথা অগ্রাহ্য করে বাবা-মা নিশ্চয়ই জোর করে তার বিয়ে দিয়ে দেবেন না! সহপাঠিনীর কাছ থেকে সে কিন্তু এ বার শোনে, বিয়ের দিন পর্যন্ত স্থির হয়ে গিয়েছে। পাত্র তাদেরই এক আত্মীয়।
টুম্পা সে দিন আর স্কুলে যায়নি। রাস্তা থেকেই বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু বাবা-মা তার প্রতিবাদকে কোনও গুরুত্ব দেননি। টুম্পা আস্তে আস্তে বুঝতে পারে, গোটা পাড়াই তার বিয়ের কথা জানে। কেবল তাকেই বলা হয়নি। তার অজান্তেই সব ঠিক করে ফেলেছিলেন তার বাবা মোরজেম আলি ও মা সানোয়ারা বিবি।
টুম্পা পড়াশোনা দেখিয়ে নিতে অনেক সময় যায় গ্রামেরই পলি ঘোষের কাছে। তিনি একটি স্কুলের শিক্ষিকা। তাঁর কথায়, “টুম্পা আমাকে খুব বিশ্বাস করে। কোণঠাসা অবস্থায় আমার কাছেই এসেছিল। সব কথা শুনে ঠিক করি স্থানীয় বিডিও ও পঞ্চায়েতকে জানাতে হবে।” প্রশাসন ও পঞ্চায়েত কর্তারা অবশ্য সহজে মোরজেম-সানোয়ারাকে
|
প্রতিবাদী টুম্পা।
নিজস্ব চিত্র। |
রাজি করাতে পারেননি। মোরজেম বলেন, “আমি দিনমজুর। আট সন্তান। সংসার চালাতে নাজেহাল হয়ে গিয়েছি। তাই ভাল পাত্র পেয়ে টুম্পার অজান্তেই বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলাম।” শেষ পর্যন্ত অবশ্য শনিবার প্রশাসনের চাপেই বিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। সেই দিন ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন পঞ্চায়েত কর্তারা। সানোয়ারা বিবি বলেন, “আমার আগের ৩ মেয়ের অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, দিন বদলেছে। মেয়েরা ছোট হলেও নিজেদের ভাল-মন্দ বুঝতে শিখেছে। তাই বিয়ে ভেঙে দিয়েছি।”
স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিজয় হাজরা বলেন, “অল্প বয়সে বিয়ে হলে কী কী ক্ষতি হয়, তা ওই পরিবারকে বোঝানোর পরেই তাঁরা বিয়ে ভেঙে দিতে রাজি হন।” সুতি ২ ব্লকের যুগ্ম বিডিও বিমানচন্দ্র দাসের কথায়, “বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে গোটা এলাকা জুড়েই প্রচারে জোর দেওয়া হবে। তবে ওই কিশোরী নিজেই এগিয়ে আসায় দৃষ্টান্ত তৈরি হল।”
পুরুলিয়ারও প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা কিশোরী রেখা কালিন্দী, বীণা কালিন্দী বা নদিয়ার করিমপুরের পূজা মণ্ডলের মতো সুতির টুম্পা খাতুন এই ভাবে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের বিয়ে ভেঙে পড়াশোনা করতে চাওয়ায় এ বার নাবালিকা বিবাহের প্রবণতায় ভাঁটা পড়বে বলে মনে করছেন ওই গ্রামের বাসিন্দারা। খুবই পিছিয়ে পড়া এলাকা রঘুনাথপুরের কাছাকাছি রেলস্টেশন বলতে চার কিলোমিটার দূরের সুজনিপাড়া। জাতীয় সড়ক পাঁচ কিলোমিটার। সাক্ষরতার হার ৩৮ শতাংশ। বেশিরভাগ মানুষেরই রুজি রোজগার বিড়ি বাঁধা। অল্প কয়েকজন দিনমজুরের কাজও করেন। গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়টি টুম্পাদের বাড়ির ঠিক পাশেই। কিন্তু হাইস্কুল দেড় কিলোমিটার দূরে। রঘুনাথপুরের মূল রাস্তায় পিচ পড়েছে। কিন্তু বাকি প্রায় সব রাস্তাই কাঁচা। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতেই বিদ্যুৎ নেই। টুম্পাদের বাড়িতেও নেই। পঞ্চায়েত প্রধান আরএসপি’র রাজেশ শেখ বলেন, “দারিদ্র আর অশিক্ষা থেকে মুক্তি র জন্য আমরা উদ্যোগী হয়েছি। রাস্তা সারানো হবে। সব বাড়িতে বিদ্যুৎ আনার চেষ্টাও শুরু হয়েছে।”
পলি বলেন, “টুম্পা একা নয়। তার মতো অনেক মেয়েই এখন পড়াশোনা করতে চায়। তারা বাবা-মায়ের ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদও করতে পারছে। এখন দরকার তাদের ঠিক মতো আগলে রাখা। যাতে তারা সত্যিই পড়াশোনা করে যেতে পারে।” |