জল্পনা আংশিক সত্য হল। গত কাল গভীর রাতে ওড়িশার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল, মুক্তি পেয়েছেন দু’জন ইতালীয়ই। আজ দেখা গেল, অপহৃত দুই ইতালীয়ের এক জন, ক্লদিও কোলাঙ্গেলো-কে মুক্তি দিয়েছে মাওবাদীরা। দরিংবাড়ি শহরের কাছে স্থানীয় সাংবাদিকদের হাতে তাঁকে অক্ষত অবস্থায় তুলে দেওয়া হয়েছে। অপহৃত আর এক ইতালীয় পাওলো বোসুস্কো ও বিজেডি বিধায়ক ঝিনা হিকাকাকে নিয়ে অবশ্য উদ্বেগ রয়েই গেল প্রশাসনের। কারণ, বাকি দু’জন মাওবাদীদের দু’টি ভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে বন্দি রয়েছে বলে সন্দেহ আরও জোরদার হয়েছে আজ। এবং দুই গোষ্ঠীর বিরোধের জেরে বাকি দু’জনের বিপদ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা।
স্থানীয় একটি টিভি চ্যানেলকে মাওবাদীদের রাজ্য কমিটির শীর্ষ নেতা সব্যসাচী পণ্ডা জানিয়েছেন, ‘শুভেচ্ছার বার্তা’ দিতেই এক জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার তাদের দাবিদাওয়া পূরণের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে, তার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত অন্য ইতালীয় নাগরিককে মুক্তি দেওয়া যাবে না। মধ্যস্থতাকারীদের নতুন করে আলোচনায় বসারও আহ্বান জানিয়েছেন সব্যসাচী। ঘোষণা করেছেন, আলোচনা চলার সময় তাঁরা অস্ত্র সংবরণ করে থাকবেন। তবে অন্য কোনও গোষ্ঠীর দায়িত্ব নিতে পারবেন না বলেও পণ্ডা তাঁর বিবৃতিতে স্পষ্ট জানিয়েছেন। সব্যসাচীর এই মন্তব্য ও ঝিনা প্রসঙ্গে তাঁর নীরবতা থেকেই স্পষ্ট, অপহৃত বিধায়ক অন্য কোনও গোষ্ঠীর হাতে বন্দি রয়েছেন। কিন্তু ওই গোষ্ঠী ঝিনার মুক্তির জন্য কোনও শর্ত বা দাবির কথা না জানানোতেই চিন্তা বেড়েছে প্রশাসনের। |
প্রশ্ন উঠছে, কেন ‘শুভেচ্ছা বার্তা’ দিতে চাইছেন সব্যসাচী? প্রথম কারণ অবশ্যই নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ে আলোচনার পথ খোলা রাখা। শুক্রবার গভীর রাতে কোরাপুট জেলায় লক্ষ্মীপুরের বিধায়ক ঝিনাকে মাওবাদীরা অপহরণ করার পরেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা ভেস্তে যায়। হাত তুলে নেন দুই মধ্যস্থতাকারীই।
তবে ‘শুভেচ্ছা বার্তা’ হিসেবে ক্লদিওকে মুক্তি দেওয়ার পিছনে আর একটি ছকও থাকতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ। সব্যসাচীর বিরুদ্ধ-গোষ্ঠী বিধায়ক অপহরণের মতো ঘটনা ঘটিয়ে সংগঠনে তাঁর কর্তৃত্ব নিয়েই শুধু প্রশ্ন তুলে দেয়নি, কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে যৌথ অভিযানের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গোয়েন্দারা মনে করছেন, সব্যসাচীর সুর নরম করার অন্যতম লক্ষ্য হল, কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ এড়ানো। কারণ, বিধায়ক অপহরণের পরপরই মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক কাল যে রকম তৎপরতা দেখিয়েছেন, কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে, তা চিন্তা বাড়িয়েছে মাওবাদী নেতৃত্বের। নবীনকে কেন্দ্রীয় সাহায্যের আশ্বাসও দিয়েছেন চিদম্বরম। নবীন রাজি হলে আরও তীব্র হতে পারে যৌথ বাহিনীর অভিযান। অথচ ওই অভিযান বন্ধ করাই মাওবাদীদের ১৩ দফা দাবির অন্যতম। তাঁদের আর একটি উল্লেখযোগ্য দাবি, সব্যসাচীর স্ত্রী শুভশ্রী দাসের মুক্তি।
এক উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা-কর্তার বক্তব্য, শীর্ষ নেতৃত্বে সব্যসাচী পণ্ডা আপাতত কিছুটা কোণঠাসা। সংগঠনে নিজের দাপট জাহির করতেই তিনি ইতালীয়দের অপহরণ করিয়েছেন। ‘ওড়িশা স্টেট অর্গানাইজিং কমিটি’ তার দায় স্বীকার করে বিবৃতিও দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সংগঠনে তাঁর কোনও কর্তৃত্ব নেই, সেটা প্রমাণ করতেই অন্ধ্র সীমানায় সক্রিয় একটি গোষ্ঠী অপহরণ করেছে বিধায়ককে। ওই গোয়েন্দা কর্তার সন্দেহ, নিজের সংগঠনেই অস্বস্তিতে পড়ে সব্যসাচী আপাতত সময় কিনতে চান।
জটিল এই পরিস্থিতি পর্যালোচনায় মুখ্যমন্ত্রী নবীন আজ ফের পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন। কিন্তু দিনের শেষে ধোঁয়াশাতেই রয়ে গিয়েছে রাজ্য প্রশাসন। বিধায়ক ঝিনার কোনও খবরই পাওয়া যায়নি রাত পর্যন্ত। তবে মুক্তির পরে নিজের ‘আতঙ্কের’ কথা জানানোর পাশাপাশি ক্লদিও বলেছেন, “সঙ্গী পাওলো বোসুস্কোকে আজ সকালেও সুস্থই দেখে এসেছি। আসুন প্রার্থনা করি, তিনিও যেন নিরাপদে ফিরে আসতে পারেন।” কোনও রাজনৈতিক প্রসঙ্গে যেতে রাজি না হলেও ক্লদিও জানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে গত ১১ দিন কোনও রকম দুর্ব্যবহার করা হয়নি। বরং যথাসাধ্য দেখভালই করেছে মাওবাদীরা। ক্লদিও-র আরও দাবি, পুলিশের নিষেধ উপেক্ষা করে তাঁরা আদিবাসী এলাকায় ঢুকেছিলেন বলে যা বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। পুলিশ তাঁদের সতর্ক করেছিল ঠিকই, তবে তারা অনুমতি দেওয়ার পরেই তাঁরা আদিবাসী এলাকায় ঢুকেছিলেন। অপহরণের সময় তাঁরা নদীতে স্নান করতে নেমেছিলেন। আদিবাসীদের ছবি তুলছিলেন না। |