কাটোয়ায় প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জমি কিনতে কবে তারা মাঠে নামবে, এনটিপিসি এখনও তা নির্দিষ্ট করে জানায়নি। কিন্তু কবে জমি বিক্রির প্রস্তাব দিয়ে তাদের তরফে চিঠি আসে, বেশির ভাগ জমিমালিক এখন তারই প্রতীক্ষায় আছেন।
তথাকথিত ‘উর্বর’ জমিতে শিল্প গড়া নিয়ে রাজনীতির চাপানউতোরে ইতিমধ্যেই বড়সড় ‘পরিবর্তন’ ঘটে গিয়েছে রাজ্যে। কারখানা অনেকখানি গড়ে ফেলেও সিঙ্গুর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে টাটা মোটরস। দখল-পুনর্দখলের লড়াই শেষে দেশে জমি আন্দোলনের ‘আইকন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে নন্দীগ্রাম। কিন্তু রাজ্যের ‘শস্যগোলা’ বর্ধমানেই উর্বর জমির মালিকেরা আর জমি আঁকড়ে বসে থাকতে চাইছেন না।
প্রস্তাবিত এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের শিলান্যাস হয়েছিল ২০০৫ সালে। বাম আমলেই ৫৫৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম (পিডিসিএল)। পরে তারা হাল ছেড়ে দেওয়ায় জাতীয় তাপবিদ্যুৎ নিগম (এনটিপিসি) নির্মাণের দায়িত্ব নেয়। এখনও ৫০০ একরের বেশি জমি প্রয়োজন। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, তাঁর সরকার শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে না। এর পরে মমতার শর্ত মেনে এনটিপিসি সরাসরি জমি কিনতে নেমেছে। সেই সঙ্গে, শিল্প সংস্থার পক্ষে জমি নিজে কিনে নেওয়া সম্ভব কিনা, তারও প্রথম পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে।
পিডিসিএলের তৈরি করা মানচিত্র অনুযায়ী, মূলত শ্রীখণ্ড মৌজায় ২২০ একর, জাজিগ্রাম মৌজায় ২৩৫ একর ও চুড়পুনিতে ৬৬ একর জমি নেওয়া এখনও বাকি। এর মধ্যে শ্রীখণ্ড ও জাজিগ্রামে তৈরি হবে ছাই ফেলার ‘অ্যাশ পন্ড’। মূল প্রকল্প হবে আগে অধিগৃহীত ৫৫৬ একর জমিতে। জমি অধিগ্রহণের সময়ে ‘কৃষি, কৃষক ও খেতমজুর কমিটি’ গড়ে বাধা দেওয়া ও দর কষাকষির রাস্তা নিয়েছিলেন জমি মালিকেরা। কিন্তু এখন আর সেই কমিটির অস্তিত্ব নেই। বরং কমিটির নেতারাই এখন জমি দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছেন।
সম্প্রতি শ্রীখণ্ডে এনটিপিসি-র ‘ফিল্ড অফিসে’ গিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার শিবাশিস বসুর সঙ্গে দেখা করেন কমিটির তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক দেবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “পুরো বিষয়টি জানতে গিয়েছিলাম। বলে এসেছি, বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে ওঁদের কোনও অসুবিধা হবে না।” কমিটির তৎকালীন সম্পাদক তপন ঘোষও বলেন, “ন্যায্য মূল্য পেলে চাষিরা কোনও আন্দোলনের পথে যাবেন না।” অধিগ্রহণের সময়ে যে কদমপুকুর গ্রাম থেকে ব্যাপক বাধা এসেছিল, সেখানকার আবুল কালাম মল্লিক, সুরাত আলি মল্লিকেরাও একই কথা বলছেন।
শ্রীখণ্ড পঞ্চায়েত তথা সিপিএমের কাটোয়া ১ উত্তর লোকাল কমিটির সদস্য নাদিরুদ্দিন মোল্লার ধারণা, “আমাদের শ্রীখণ্ড উত্তরপাড়া থেকেই বেশি জমি নিতে হবে এনটিপিসি-কে।
সঠিক মূল্য পেলে আমরা জমি দিতে রাজি।” স্থানীয় তৃণমূল নেতা সৌমেন্দ্র দে-র দাবি, “সিপিএম চাষিদের সঙ্গে প্রতারণা করেছিল। আমাদের সরকার সরাসরি ওঁদের সঙ্গে কথা বলেই জমি নিতে বলেছে। চাষিরা উন্নয়নের স্বার্থে ন্যায্য দামের বিনিময়ে জমি দেবেন।” শ্রীখণ্ড পঞ্চায়েতের কংগ্রেস প্রধান দীপক মজুমদার বলেন, “এনটিপিসি জমি নেওয়ার চিঠি দিলেই ওঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে যাব।”
কাটোয়ার উর্বর জমির মালিকেরা জমি বিক্রিতে উৎসাহী কেন? চাষিদের বড় অংশের মতেই, চাষ আর তেমন লাভজনক নেই। একে তো ভূমিবণ্টনের ফলে কারও হাতেই বেশি জমি নেই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তার শরিকের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে। আরও টুকরো হচ্ছে জমি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল নষ্টের ঝুঁকি চিরকালই ছিল। কিন্তু এখন উন্নত বীজ ও সারের দৌলতে অতিফলন হলেও যথাযথ বিপণন ব্যবস্থা না থাকায় সেটাই অভিশাপ হয়ে আসছে। গত মরসুমে ধান ও আলু চাষে অতিফলনের ক্ষতি তাঁদের এখনও বইতে হচ্ছে। এবং তার জেরে চাষির আত্মহত্যার সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে বর্ধমানেই।
স্থানীয় বাননাগরা গ্রামের রঘুনাথ মণ্ডল, শ্রীখণ্ড গ্রামের প্রান্তিক চাষি হবু শেখদের আক্ষেপ, “কায়িক শ্রম দিয়েও জমি থেকে লাভ মিলছে না। জমি আঁকড়ে বসে থাকার চেয়ে ভাল দামে বিক্রি করা ভাল।” চুড়পুনি গ্রামের অজিত ঘোষ, দেবকুন্ডু গ্রামের পরিমল ঘোষদের মতে, “চাষের হাল খারাপ। কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের কথা মাথায়
রেখেই অনেকে জমি দেবেন।” শ্রীখণ্ডের হবিবুল্লা শেখ, গোলাম রহমানেরা সরাসরি বলেন, “সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের অবস্থা তো দেখছি! চাষ করতে পারছে না, টাকাও পায়নি। এই ভয়েই আমাদের এখানে জমি আন্দোলন
ভেঙে গিয়েছে।”
সেই সিঙ্গুর, যেখানে টাটাদের মোটরগাড়ি কারখানা গোটা এলাকার অর্থনীতিতে জোয়ার আনতে পারত, কিন্তু অধিগৃহীত জমির জন্য চেক না নেওয়া চাষিদের বেশির ভাগই এখন দারিদ্রের সঙ্গে যুঝছেন। মমতা মুখ্যন্ত্রী হওয়ার পরে হুগলি জেলা প্রশাসন রাতারাতি কারখানার ‘দখল’ নিলেও টাটারা আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায় ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের জমি ফেরত পাওয়ার আশা আপাতত বিশ বাঁও জলে। ন’মাস আগেও যাঁরা আশায় বুক বাঁধছিলেন, এখন তাঁদের গলাতেই ঝরে পড়ছে আক্ষেপ।
যেমন, সিঙ্গুরের বারো হাত কালীতলার গোপাল মালিক। বিঘে পাঁচেক জমির গোটাটাই কারখানার পাঁচিলের ভিতরে চলে গিয়েছে। তখন চেক না নেওয়ায় এখন তাঁর সম্বল খেতমজুরি। তাঁর খেদ, “যারা চেক নিয়েছে, তারা তবু সে টাকা ব্যাঙ্কে রেখে সুদ পাচ্ছে। আমরা আদালতের গেরোয় ফেঁসে গেলাম। কবে কী হবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। দিন গুজরান করাই দায়।” পারিবারিক মন্দির-সহ বিঘেখানেক জমি গিয়েছে গোপালনগরের গণেশ চক্রবর্তীর। তাঁর বক্তব্য, “আগের সরকার জোর করে সেই জমি নিয়েছিল। কিন্তু এখন তো মোকদ্দমায় ফেঁসে সব পড়ে রয়েছে।”
যা দেখে-শুনে কাটোয়ার গোলাম রহমান, হবিবুল্লারা এখন বলছেন, “আর এ ধরনের আন্দোলনের পথে যেতে উৎসাহী নই। বরং চাইছি, এনটিপিসি তাড়াতাড়ি জমি কিনতে চেয়ে জমিমালিকদের চিঠি দিক।”
এনটিপিসি সূত্রের খবর, স্থানীয় শ্রীখণ্ড, জাজিগ্রাম, চুড়পুনি, ন’নগর ও কোশিগ্রামে প্রায় চার হাজার চাষির জমি কেনার পরিকল্পনা আছে তাদের। ইতিমধ্যে হাজার দুয়েক চিঠির বয়ানও তৈরি হয়ে গিয়েছে। দিল্লিতে সংস্থার সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে সম্ভাব্য খরচের হিসেব। তবে অধিগৃহীত জমি এখনও রয়েছে পিডিসিএলের হাতে। রাজ্য মন্ত্রিসভা তা হস্তান্তরের অনুমতি দিলেই দিল্লি সবুজ সঙ্কেত দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই চিঠি পাঠানো শুরু হবে।
সব যদি ঠিকঠাক চলে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের দেখানো পথ ছেড়ে হয়তো অন্য ‘ইতিহাস’ লিখতে শুরু করবে কাটোয়া।
|
সহ প্রতিবেদন: গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় |