রবিবাসরীয় গল্প
জেনানা ফাটক
বাইরের দেওয়ালে একটা পুরনো নথির কপি ফ্রেম করে বাঁধানো আছে। কয়েদির হাইট পাঁচ ফুট ছ’ইঞ্চি। বয়স তিপান্ন। জেলের কাছে জমা রাখা টাকা-পয়সার বিবরণী দুশো সাঁইত্রিশ টাকা, ছ’আনা। নাম মোহনদাস করমচন্দ গাঁধী। কয়েদের মেয়াদ উনিশশো বাইশ থেকে আঠাশ। সেকালে পাথুরে গাঁথনি, উঁচু সিলিং। জানলা নেই, কেবল একটা স্কাইলাইট দিয়ে আলো আসে। সেলটা এখন খালি। সুন্দর করে রং করা, সামনের দরজাটা হাট খোলা। দরজার পাশে পাথর বাঁধানো তাকের উপর কেউ কেউ ফুল রেখে যায়। ছোট পেতলের রেকাবে পারিজাত ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক জন। জেলের পোশাক পরা। যাবজ্জীবনের আসামি। এ দেশে শিউলিকে বলে পারিজাত। ফুল হাতে তুলে নিতে গেলে বোঁটার রং মাখামাখি হয়ে যায় আঙুলে। পিছন থেকে জেলার রুমাল বাড়িয়ে দেয় মুছে নেবেন?
গাঁধীর পাশের সেল-এ থাকতেন বল্লভভাই পটেল। তার পাশের সেল-এ মতিলাল নেহরু। এখন কেউ থাকে না। ঝকঝকে উঠোনের সামনে ফুল ও গাছপালায় সাজানো বাগান। বিশাল এক আমের গাছ ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে রোদে। এর নীচে বসেছিলেন অম্বেডকর আর গাঁধী। ‘পুণে প্যাক্ট’ লেখা হয়েছিল এইখানে। ইতিহাসরঞ্জিত গম্ভীর স্তব্ধতার মধ্যে পেতলের রেকাবি ধরা ওই লোকটা বেমানান। চোখের নীচে গভীর কালি, শুকিয়ে কালচে হয়ে যাওয়া ঠোঁট। হাফপ্যান্ট, নীল উর্দি, ওই রঙের টুপি। ও কি বুঝতে পারছে ওর হাতের রেকাবির ফুল কার কার নামে ছড়ানো হচ্ছে?
পাশেই জেনানা ফাটক। জেলার গলা নিচু করে বলে ওর বউ ওখানে আছে। তারও যাবজ্জীবন।
দুটো জেলের মধ্যে একটা ন্যাড়া ধুলোটে মাঠ। পুরুষ-জেলটার বয়স দেড়শো বছর, মেয়ে-জেলটার পঁচাত্তর। অনেক তফাত হলেও অনেকটা সেকেলে স্বামী-স্ত্রীর মতন মানিয়ে যায়। মাঝখানে ধুলোমাখা শূন্যতা নিয়ে যেন বুড়োবুড়ি দাঁড়িয়ে আছে, রোদে পুড়ছে, জলে ভিজছে, শিউরে উঠছে শীতের বাতাসে...
জেনানা ফাটকের ভারী, বিরাট দরজাটা শব্দ না করে খুলে যায়। অঘ্রান দুপুরের আলোয় ভিতরে একটুখানি ফাঁকা জমি চোখে পড়ে, ডান হাতে রান্না ঘর। মাটি খুঁড়ে জলের নতুন কল বসানো হয়েছে। ‘এখানে জলের বড্ড কষ্ট।’ মেয়ে-জেলার পিছন পিছন আসছে।
পাইপগুলি খড়খড়ে শুকনো, নতুন। এদের ভিতর দিয়ে জলের চলাচল এখনও আরম্ভ হয়নি। মানে, জলের কষ্ট এখনও আছে।
সামনের বর্ষার আগেই জল এসে যাবে।
সারি সারি নতুন বাথরুমও গাঁথা দেখা যাচ্ছে। এত সরু বাথরুমে পৃথিবীর সবচেয়ে সাইজ জিরো মেয়েকেও আড় হয়ে দাঁড়াতে হবে।
চালু হয়েছে এগুলো?
হব হব করছে। রোজ বাথরুম গিয়ে লাইন, দরজা ধাক্কানো, চিৎকার... শেষ কালে কোর্টের অর্ডারে...
কোর্টের অর্ডার ছাড়া কিছু হয় না এ দেশে।
তা নয়, মানে...
রান্নাঘরটা ঝকঝকে। যেন শেষ রান্না হয়েছিল ইন্ডিয়ান পেনাল কোড চালু হওয়ার আগে। এক ফোঁটা জলও পড়ে নেই। একটুও ধুলো, কারও মাথার চুল, পেঁয়াজের খোসা... কিচ্ছু না।
ডালা দেওয়া কাঠের বাক্সে খাবারের নমুনা রাখা। কুচকুচে কালো ডাল, ওই রকমই কালো সিদ্ধসিদ্ধ একটা আলুর তরকারি, চারটে মস্ত রুটি, এক বাটি মোটা চালের ভাত।
সকালের জলখাবার হয়ে গিয়েছে? দুপুরের খাওয়া?
সব সব।
এত তাড়াতাড়ি দুপুরের খাওয়াও...
আজ সবাই দশটাতেই খেয়ে নিয়েছে, তাড়াতাড়ি... ইন্সপেকশনের দিন সকালেই খাইয়ে দিই।
তাই বুঝি রান্নাঘর এত ঝকঝকে... তারিফ করার মতো... রেকাবিতে ফুল ধরা ওই লোকটার বউটাকে খুঁজে বার করতে হবে, সে কোন ব্যারাকে, কে জানে...
চৌকো একটা ঘরে, রোদ নেই আবছায়ায় ঠাসাঠাসি বসে আছে ষাট-সত্তর জন মেয়ে, বুড়ি, যুবতী, বয়স্কা... কারও মুখে কথা নেই, হাতের তালু ধূপের মশলায় কালো, চুপচাপ কাঠি গড়িয়ে ধূপকাঠি বানিয়ে চলেছে; নড়াচড়ার জায়গা নেই, ঠাসাঠাসি ঘর... কনুই তুললে পাশের জনের গায়ে ধাক্কা লাগে।
এক কিলো মালে চল্লিশ টাকা মজুরি। সব এদের নামেই জমা হয়।
এক দিনে এক কিলো হয়?
এক কেন, দেড়... দুই...
মানে দিনে আশি টাকা পর্যন্ত রোজগার, বাঃ...
দ্বিতীয় সারির কোনায় বসা উচ্ছলা তরুণীটির হাসি ভরা চোখের চাউনি উঠে আবার নেমে যায় ধূপের মশলায়।
দেখি, তোমার কতটা হল, সকাল থেকে?
আধা কিলো হবে।
এক এক জনের হাত আস্তে চলে।
পিছন থেকে জেলার বলে ওঠে।
তুমি খেয়েছ?
মেয়েটির চোখের হাসি একটু চলকে উঠেই নিভে যায়। মাথা নাড়ে, যার মানে, হ্যাঁ, না, দুটোই হতে পারে।
কেউ খায়নি, এখানে...
গুমগুম করে বলে পাশের প্রৌঢ়া, যার মাথায় আঁট আধ ঘোমটা সেই সকালে দুটো মণ্ড চিঁড়ে... সাড়ে সাতটায়...
আরে এদের ছেড়ে দিন, কেউ খায়নি যে...
ছেড়ে দেব?
এক্ষুনি। এই বললেন, দশটায় দুপুরের খাওয়া হয়ে গিয়েছে...
বিরাট একটা পিঁপড়ের সারির মতো ধূপের মশলায় কালো হাত পাছায় উরুতে মুছতে মুছতে মেয়ে শ্রমিকের দল বলতে থাকে ঠান্ডা হয়ে জুড়িয়ে যাওয়া কালো ডাল, সিদ্ধ সিদ্ধ তরকারি আর গ্রামোফোন রেকর্ডের মতন রুটির টানে...
একটু পরে দেখা যায় সবাই নিজের নিজের ব্যারাকে বসে উপুড় হয়ে খাচ্ছে, চড়া খিদের খাওয়া, অন্য কোনও শব্দ নেই, রুটি-ভাত চিবোনোর, সুড়ুৎ করে ডাল টেনে নেওয়ার আওয়াজ ছাড়া...।
ছোট বাচ্চারা মায়ের কোলে বসে, অথবা পাশ ঘেঁষে খাচ্ছে। ওই রুটি ওদের গলায় আটকে যাওয়ার কথা, অথচ বেশ গিলে নিচ্ছে। অত ঝালে বিষম খাওয়ার কথা, কারও কোনও কষ্ট হচ্ছে না...
অভিমান-মাখা গলায় মেয়ে জেলার বলে, ‘ওরা পাঁউরুটি পায় আলাদা করে, ছোট বাচ্চারা, একটা কলা, একটা ডিম... সকালে নার্সারি স্কুলেও যায়, এই জেলের ভিতরেই ওখানে টিচার আসে, এবিসিডি শেখায়...’
লম্বা, সরু ব্যারাকে ঠাসাঠাসি আশি জন মেয়ে কয়েদি, আট-দশটা বাচ্চা। কেউ হামাগুড়ি দিচ্ছে, কেউ মেঝে থেকে মুড়ি খুঁটে খাচ্ছে, কেউ মায়ের বুকে আঁকড়ে ঝুলে আছে।
রাতে ঘুমোতে পারি না এত ঠাসাঠাসি, স্নানের জল নেই, বাথরুমে লাইন পড়ে...
থেমে থেমে বলে, তবু তো ইংরাজি। মাদক পাচারের আসামি উগান্ডার দুই মেয়ে লারা আর ব্রুনা।
‘আর ওই বাচ্চাগুলো কেবল কাঁদছে, চেঁচাচ্ছে...’
আপিল করেছ?
করেছি। উকিল অনেক দূরে। ডাকলেও আসে না। কেস-এর কী হচ্ছে, আমরা কেউ জানি না...
যারা ইংরাজি বলে, তাদের ‘আপিল’ আর যারা কথা বলতে মুখে তালা লাগায়, তাদের ‘তুমি’? বাকস্বাধীনতার গণতন্ত্রে কি দুই পৃথিবী? কে জানে?
এই সবে ট্রায়াল আরম্ভ হল, মাস চারেক এখানে পাঁচ বছর হয়ে গেল আমার। যে বলে ওঠে, তার জ্বলজ্বলে দুই বড় চোখে খর চাউনি, সোনালি চশমা, মুখের পর্দা ওঠানো।
কিছু বলবেন? কোনও অভিযোগ-শিকায়েৎ আছে?
কী-ই বা বলব? বলেই বা লাভ কী? মেয়েদের এক চোটেই যাবজ্জীবন দেয় কেন বলুন তো? একটু কম সাজা দিলে কী হয়?
কোনও মেয়ে যদি যাবজ্জীবনের সাজা পাওয়ার মতো অপরাধ করে, তবে মেয়ে বলে কি তার সুবিধে পাওয়া উচিত?
আপনারা ভাল বুঝবেন!
নামটা লিখে নিতে গিয়ে বুকে একটু কাঁপন ধরে। খুব চেনা নাম। জ্বলজ্বলে চোখ দুটো এ বার সোজা আমার চোখে। ঠোঁটে ধারালো হাসি।
মনে পড়ে গিয়েছে তো? মুম্বই ব্লাস্ট কেস ১৯৯৩? মনে পড়ে গিয়েছে। চাঁদের গহ্বরের মতো ওপড়ানো রাস্তা, ভাঙাচোরা, উড়ে যাওয়া দোকানের শাটার, ফুটপাথে সারি সারি রক্তাক্ত লাশ... ওখান দিয়ে যেতে গেলে দৃশ্যগুলো মনের মধ্যে ভেসে উঠবেই। রক্তগুলো শুকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে রং কেবল সিপিয়ার দিকে চলেছে, যত দিন যাচ্ছে। ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আবার কিচেনের পাশ দিয়ে রাস্তা।
বেলা পড়ে গেছে। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে লজ্জায় সারি সারি দাঁড়িয়ে গেছে, নীল পাড় সাদা শাড়ি পরা ছোটখাটো মেয়েরা, হাতে সদ্য মাজা থালা-বাটি, খেয়ে উঠেছে।
বাড়ি কোথায়?
বাংলাদেশ।
জেলা?
নড়াইল।
তোমার? তোমার? তোমারও? তুমি?
সব নড়াইলের মেয়ে।
কী কেস তোমাদের গো?
লোকের বাড়ি কামধাম করে খাইতে ছিলাম। আমরা, আমাদের মানুষ।
জেলে কী করে?
শীর্ণ হাসি ফুটে ওঠে নড়াইলের মেয়েদের মুখে।
পাসপোর্ট ছিল না আমাগো।
পাসপোর্ট ছাড়া চলে এলে?
কী করি, পেটের বড় জ্বালা?
এ বার তো ছাড়া পাবে, ফিরে গিয়ে কী করবে?
আল্লা জানেন, তিনিই ঠিক করবেন।
ওরা পাকশালার কড়িবর্গার দিকে আশাশূন্য চোখ তুলে বলে।
মুর্শিদাবাদ-বলাংগীর-বনগাঁর মেয়েরাও কি এমন ওপারের কোনও কারাগারে হাতে থালা-বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে?
যে দালালরা কাজের খবর আনে, জাল কাগজপত্র তৈরি করে সীমান্ত পার করায়, যারা কাজের নামে মানুষ বেচে নগদ টাকায়, তারা কখনও জেলের ভিতরে থাকে না। ক্ষুধার্ত মেয়েরা তাদের কোলের বা গর্ভের শিশু, ক্বচিৎ কখনও তাদের স্বামীরা, ধরা পড়ে সোজা জেলে চলে যায়।
সারি সারি ছায়াঘন ব্যারাকের ভিতর ঢুকে বসে আছে কত ছোট শহর, গেরস্থালি, রান্নাঘর, কত গ্রামগঞ্জ, গোয়াল, পাকশাল, ঢেঁকিঘর, খিড়কি বাগান, বিড়ি কারখানা, স্বনির্ভর দল।
মেয়েরা বড় ভালবাসে সংসার সংসার খেলা। ভাত রাঁধা, ধান ঝাড়াই, চাল কোটা; জল তোলা, কাঠ আনা, ফলপাকুড়, হাঁসের ডিম, বাঁশের পাতা, ঝাঁটার কাঠি কুড়িয়ে বাড়িয়ে আনা। তারা সই পাতায়, আর সন্তানের বিয়ে থা দিয়ে কুটুম বানানোর স্বপ্ন দেখে। পেটের ভাত জোগাতে তাদের কেউ দেশান্তরী হয়, চোরাচালানে জুটে যায় কেউ, কেউ সংসার খেলায় লোভী আর স্বার্থপর হয়ে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র আঁটে, ছেলের বউ, স্বামীর প্রেমিকা, অথবা প্রেমিকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বামীকেই। আত্মরক্ষা আর ইজ্জত বাঁচাতে, মেয়েদের করা অপরাধকে কাগজপত্রে ছাড় দেয় না পুলিশ। কৌটো বন্দি নুড়ির মতন কারাগার তাদের একত্র রাখে, নাড়ায়-চাড়ায় ঝাঁকায়, পালাতে দেয় না কৌটোর বাইরে। ওই যে শক্ত মুখে রাগী বৃদ্ধা নিজের যুবতী মেয়ের চুল টেনে বেঁধে দিচ্ছে মা মেয়ে দু’জনেই এখন কৌটোর ভিতর। দু’জনেরই যাবজ্জীবন। অনেকগুলো বউ মারা কেস এখানে।
আমার বুড়োটা ওই দিকে, মরদদের জেলে। দুটো ছেলে ছিল বাড়িতে। হার্টের অসুখে মরেছে। এখানে আমি আর মেয়ে।
আইনের কোন ধারায়... আপনারা?
তা তো জানি না। বউটা গায়ে আগুন দিয়ে মরেছিল।
ব্যারাকের আদ্ধেকই এই কেস। কানুন কড়া হয়েছে তো, জেলার বলে, ‘চারশো আটানব্বইয়ের এ’, তার ওপর মার্ডারের চার্জ।
ও দিকের জেলে ফুলের রেকাবি ধরে যে দাঁড়িয়েছিল, তার বউটা কই? সে মানুষটা তো দেখলাম বেশ জোয়ান...
ওদের কেস ছোট ভাইয়ের বউয়ের। মেয়ে আসামিটার মনের রোগ হয়েছে বোধ হয়। জেলের ভিতরকার হাসপাতালে আছে।
কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রোল এই সব দাহ্য বস্তু কেমন যেন নিজে থেকেই বউগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে যায়। নারী যতটা জ্বলনশীল, পুরুষ ততটা নয়। ব্যারাকের ভিতর রাতে ঘোরে, ফিসফিসিয়ে কথা বলে, হাসে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মরা কেসরা।
ছোট একটা ব্যারাক, হয়তো এক পাশে অফিসঘর ছিল, সেটা এখন হাসপাতাল হয়ে গিয়েছে। মেয়ে ডাক্তার এসে একবেলা দেখে যায়। জ্বরের, পা ভাঙার রোগী আছে, আবার মনেরও।
সেই মেয়েও আছে। যুবতী বউ। বর যে ও দিকের জেলে, এখন হয়তো মনেও নেই তার। মাথাটা কাজ করে না। ফ্যালফ্যাল করে কড়িকাঠে তাকিয়ে শুয়ে আছে। দেওরকে ঢাকঢোল বাজিয়ে বিয়ে দিয়ে এসেছিল দাদা বউদি। দেশলাই-কেরোসিনে তাদেরই আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। কী যে ভাবে, কেন যে মানুষকে জীবন থেকে উপড়ে নিতে চায় মানুষ!
আরও আরও ব্যারাক আছে ও দিকে, দুটোতে তো ভর্তি আন্ডার ট্রায়াল... দেখবেন?
জেলার চেষ্টা করছে অধৈর্য না হতে, মাসের মধ্যে পাঁচ বার এই ভাবেই অতিথিদের ঘুরিয়ে দেখাতে হয় তাকে। কোর্টের জজ, মানবাধিকার কর্মী, কমিশন, সাংবাদিক...
রোদ মিলিয়ে আসা চত্বরে কারা যেন মেলে রেখেছে গোলাপি সায়া, ফুল ফুল জীর্ণ শাড়ি, শিশুর গায়ের নিমা, তাপ্পি দেওয়া কাঁথা গরাদের ওপারে রয়ে গিয়েছে যে জীবন, তার কিছু মায়াভরা ডাক। এরা সব আন্ডার ট্রায়াল, তাই এখনও বাড়ির পোশাক পরতে পায়। কিন্তু কবে যে জেলের পোশাক গায়ে উঠবে সেই ভেবে এদের রাতে ঘুম নেই, ভাতে অরুচি...
আসলে সবারই অনেক দিন হয়ে গিয়েছে তো, কারও দুই কারও তিন, কারও চার বছর... ট্রায়াল শুরু হচ্ছে না, কত দিন জেলে থাকতে হবে কেউ জানে না, তাই...
কাটা ঘুড়ি যেমন গোঁয়ারের মতো রাস্তায় খসে পড়তে থাকে, তেমন আন্ডার ট্রায়াল ব্যারাকের কোণ থেকে তেড়ে, ধেয়ে আসতে থাকে, হাড় জিরজিরে নগ্ন শিশু কোলে এক মেয়ে বাচ্চাটাকে এতক্ষণ দেখা যায়নি। কারণ, আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। নতুন বলে জেলের নিয়মকানুন রপ্ত হয়নি তার, তাই চেঁচাতে চেঁচাতে আসছে।
এই দেখুন, বাচ্চাটা মরে যাবে শীতে, গায়ে একটা জামা নেই, এই ভাবে চালান দিয়েছে আমায়।
জেলার গম্ভীর মুখে বলে, ‘কালই এসেছে, চুরির কেস’।
না, না, চুরি করিনি আমি। প্ল্যাটফর্মে ভিক্ষে করছিলাম। টাকা দিতে পারিনি, তাই চুরির কেস দিয়েছে, বাচ্চাটার একটা জামা আনতে পারিনি...
মাঝে মাঝে ভুল ভাল কেস দেয় পুলিশ।
বাচ্চাটার একটা জামা...
এন জি ও কে বলেছি, ওরা দেবে, আমাদের কাছে অত ছোট জামা নেই...
অত ছোট জামা নেই তো বাচ্চাশুদ্ধু চালান দিলেন কেন?
আমরা দিইনি, পুলিশ দিয়েছে।
ধনুকের মতো শিরদাঁড়া, পাঁজরা বার করা বাচ্চাটাকে একটু উত্তাপ দেওয়ার জন্য দু’হাত, আঁচল বাড়াতেই ব্যারাকের অন্ধকারে একটা জান্তব শোরগোল পড়ে যায়; যারা হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসেছিল, যারা নোংরা গদিতে আড় হয়ে শুয়েছিল। যারা মাজা বাসন গামছা দিয়ে মুছছিল, আর একটু আগে পর্যন্ত মুখ খুলতে চাইছিল না, নানা আকারের ছায়া ফেলে তেড়ে বেঁকে এগিয়ে আসতে তারা তাদের আগ্রাসী ছায়া চলাচলে ঢেকে যায় জেলারের মুখ...
দেখুন, দেখুন, আমাদের বাচ্চাগুলো একটু রোদ পায় না, সারা দিন ব্যারাকের অন্ধকারে, শীতে কাঁপে, রাতে, দিনের বেলাতেও
সেই যে সকালে নার্সারি থেকে ফেরে তার পর আর...
ওদের কী দোষ বলুন, ওরা কেন রোদ বাতাস পাবে না? জামাগুলো ভাল শুকোয় না স্যাঁৎসেঁতে...
দেখুন দেখুন ওর এ মাসে বাচ্চা হবে, তারও তো বাড় এই ফাটকের মধ্যে, অন্ধকারে... কী লাভ...
জেলার চকিত হয়ে আমার হাত ধরে টানে আসুন, শিগ্গির বাইরে আসুন, এক্ষুনি...
কেউ কোনও কথা বলছে না, অথচ ছায়াদের নড়াচড়ায় মনে হচ্ছে কত কোলাহল, আমি শুনতে পাচ্ছি...
এই দেখুন আমার হাড়ের ব্যারাম, ধূপকাঠি গড়ে গড়ে পিঠ বেঁকে গিয়েছে।
এই দেখুন আমার তেলোয় রক্ত জমে গিয়েছে তাঁতের মোটা দড়ি ধরে ধরে।
আমার বরটা কোথায় হারিয়ে গেল, সাত বছরের ছেলেটার খবর পাই না, সেও কোথাও চলে গিয়েছে কেঁদে কেঁদে...
আমার শাশুড়ি এমন বদমাস, ছেলে দুটোকে মেয়েটাকে এক বারও দেখতে দেয় না, আসতে দেয় না আজ কত, কত বছর হয়ে গেল, আর ওরা মাকে চিনবে বলুন?
ছায়া বিদ্রোহে কেঁপে উঠছে বুড়ো, পাথুরে জেনানা ফাটক। সাইরেনের শব্দ চিরে দিচ্ছে চরাচর। একটু পরে কি ইনস্যাস হাতে রক্ষীরা ঢুকে পড়বে ভেতরে? পরিষ্কার রান্নাঘর, শুকনো, জল না আসা পাইপ, আধা খ্যাঁচড়া বাথরুম পেছনে ফেলে দৌড়ে যাচ্ছে এক জন জেলার আর এক মানবাধিকার কর্মী।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.