ব্যাগ গুছিয়ে... পাহাড়িয়া যৌবনের হাতছানি
ভাওয়ালি থেকে রামগড় হয়ে কয়েক কিলোমিটার আসতেই অসাধারণ এক দৃশ্যে আবেগ চেপে রাখতে পারলাম না। ‘সিংজি, সিংজি আস্তে!’ আমার গলাটা একটু জোরেই হয়েছিল হয়তো। হেয়ার বেন্ড পিন পয়েন্টে একটা হর্ন দিয়েই গাড়ি হ্যাঁচকা টানে ডেডস্টপ। গাড়ির চাকায় ততক্ষণে লাল রক্তের মতো আঠালো রং লেপটে লুপটে একাকার। নিহত হল শত শত ঝরে পড়া থোকা থোকা অপূর্ব রডোডেনড্রন। হাজারে-হাজারে এখনও ঝরে পড়ার অপেক্ষায়। এখানে আকাশ সত্যি নীল। বাহারি সবুজ পাহাড়ি অরণ্যর মাঝে মাঝে যে দিক তাকাও আগুন লেগে গেছে রডোডেনড্রনের লাল রঙে। প্রকৃতি এখানে অবারিত মুক্ত। প্রকৃতি এখানে পুজো পায় ঈশ্বর জ্ঞানেই।
সারা মুক্তেশ্বরের আগে পিছে এই সময় লাল নীল আর সবুজের নিত্য হোলিখেলা। সামনের হিমালয় থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক শরীরকে সতেজ করে দিচ্ছে বারবার। ঝরে পড়া ‘ব্রুশ’ (রডোডেনড্রনের স্থানীয় নাম) কুড়োচ্ছিলাম সবাই। সিংজি গাছ থেকে কয়েক থোকা পেড়ে আনলেন। এই ব্রুশ থেকে অপূর্ব জুস বা সিরাপ তৈরি হয়। দারুণ খেতে। হাইব্লাড প্রেসারকে ‘লো’ করার অব্যর্থ দাওয়াই। গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার অমূল্য শরবতি, একেই বলে কুদরতি কামাল।
ভিড় নেই, কোলাহল নেই, দূষণ মুক্ত ঢেউ খেলানো পাহাড়িয়া যৌবনের হাতছানি সারা মুক্তেশ্বরে। ফুল আছে, দেদার লোভনীয় ফলের বাগিচা আছে। জংলি অরণ্যে হরেক পাখির সঙ্গে জানোয়ারের চলাফেরা আছে। আর আছে মহান শিকারি জিম করবেটের অনেক অভিযানের স্মৃতি। যার উচ্চতা সামনের হিমালয়ের চৌখাম্বা, ত্রিশূল, নন্দকোটের তুষারঢাকা শৃঙ্গের চেয়ে কম নয় এক বিন্দুও।
স্মৃতির টাইম মেশিনে চড়ে একশো বছর পিছিয়ে গেলেই এক অন্য অ্যাডভেঞ্চার...। কুমায়ুনের নরখাদক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মুক্তেশ্বরের পাহাড়ি জঙ্গলে। প্রথমে গরু-ছাগল, এখন মানুষ তুলে নিয়ে যাচ্ছে গ্রাম থেকে। আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা সাহায্য চাইলেন জিম করবেটের কাছে। জিম এসে আস্তানা গাড়লেন যে বনবাংলোতে তা আজ পূর্ত বিভাগের অধীনে। সাল ১৯১০। বহু চেষ্টায় মারা পড়ল সেই ম্যানইটার। আরও এক বার বুক চাপড়ালেন জিম, বাঘ মারার দুঃখে। সেই সময় বাংলোর চৌকিদার ও তাঁর সঙ্গী জগৎ সিংহকে স্মৃতি হিসাবে দিয়ে গেলেন তার চা খাবার ভারী কেটলিটা। হাত বদলে এখন তার ছেলে পান সিংহের কাছে। সেই বাংলোতেই রাখা কেটলিটা এখন এই মুহূর্তে কিছু ক্ষণের জন্য আমার হাতে। বসে আছি অধুনা বনবাংলোর করবেটের ঘরের উঠানের সামনে। প্রায় ১৮০ ডিগ্রি সমান্তরাল মুক্তেশ্বরের ঈশ্বরেরা মাথা তুলেছে একে একে। ওই যে একেবারে বাঁ দিক থেকে পোরবন্দি, করচাকুণ্ড, চৌখাম্বা, গৌরী, ত্রিশূল, নন্দাদেবী, নন্দকোট...। উচ্চতাগুলো নাই বা বললাম। হিমালয়সম উচ্চতা কথাটা তা হলে ক্লিশে হয়ে যাবে। বাংলোর ঠিক পিছনেই কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের (কেএমভিএন) লজ। দারুণ জায়গা। এর পাশ দিয়েই অরণ্য-পথ গেছে ‘চাউলি-কি-জালি’র দিকে। সে এক বিচিত্র জায়গা। বিকালে এলেই তবে এখানে অন্য রঙিন মজা। ঠিক আছে তাই সই।
ইন্ডিয়ান ভেটেরিনারি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিরাট কর্মকাণ্ডের নানা ছোঁয়া এখানে। সংরক্ষিত অঞ্চল বলেই বহু প্রাচীন পাইন ও দেওদাররা আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে শোভা বাড়াচ্ছে ক্রমাগত। লোভী কুঠারের হাত থেকে বেঁচে থাকবে তারা বহু দিন। উঁচু গাছের ওই ডালে ডালে পাহাড়ি ময়নারা ভীষণ সুন্দর। মানুষের নয়, নিজের বুলি আওড়াচ্ছে সঙ্গিনীর সঙ্গে।
শেষ দুপুরে স্থানীয় পণ্ডিতজির দোকানে রুটি-তরকায় যখন পেট ভর্তি হচ্ছে আর হৃদয় শান্ত হচ্ছে ব্রুশের জুসে, তখন আবার অবাক হওয়ার পালা! বড় চামচিকের মতো এগুলো কি পাখি? সাঁই-সাঁই করে জেট গতিতে দোকানে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। এত কর্মব্যস্ত যে বসার সময়ই পাচ্ছে না। এদের সুরেলা শিঙে যেন সরাইখানায় বাজছে অতিথি মনোরঞ্জনের লাইভ কনসার্ট। ‘জিও জিন্দেগী’! দুর্দান্ত শাহি পনিরের থালাটা এগিয়ে দিয়ে কর্মচারীটি হেসে বলেন, ‘হিমালয়ান লাকি বার্ড’। আমরা ডাকি ‘গুঞ্জা’ বলে। লাক বাইচান্স, যার ঘরে এরা বাসা বুনবে তার লাক ঝক্কাস! তাই তো! দোকানের কোণে, ভিতরে দিব্যি বাসা বুনে ছানা-পোনা নিয়ে চুটিয়ে সংসার করছে এরা। পারলে গায়ে-মাথায় বসে পড়তেও দ্বিধা নেই এদের। ‘বেড়ি’ ছাড়া বিহঙ্গ-মানুষের এ রকম মাখো মাখো প্রেম জীবনে এই প্রথম পেলাম। সত্যিই আমরাও লাকি।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ি ছোট্ট ট্রেকিং পথে পথ চিনে রক্ ‘চাউলি-কি-জালি’র শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াতেই বিস্ময়। এখানেই পাহাড়টার শেষ প্রান্ত, যার শুরু হয়েছিল শ’পাঁচেক মিটার দূরে মুক্তেশ্বর শিবমন্দির থেকে। শিবরাত্রিতে এই চত্বরে চলে হরেক অনুষ্ঠান। সন্তানকামী মায়ের ইচ্ছাপূরণের ব্রত চলে নিষ্ঠার সঙ্গে। এই রকি বা ন্যাড়া পাহাড়টা যেন প্রাকৃতিক বারান্দা। ঝুলবারান্দার মতো পায়ের নীচে খাড়াই হাজার তিনেক ফুটের গভীরতা। বামে, ডানে, সামনে দিকচক্রবালে পাহাড়ি হিল্লোল। সূর্য বিদায় চাইছে সতেজ প্রকৃতির কাছ থেকে। আকাশে শুরু হয়েছে রঙের খেলা। ধুলোবিহীন গোধূলি লগ্নে অরণ্যর মাঝে একটানা ঝিঁ ঝিঁ-র ডাকে সন্ধ্যাসঙ্গীত। অন্ধকার নামতেই ভেসে ওঠে আর এক ছবি, ছোট ছোট আলোর বিন্দু।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে লখনউ হয়ে কাঠগোদাম। ওখান থেকে গাড়িতে নৈনিতাল হয়ে মুক্তেশ্বর।
কখন যাবেন
যাওয়ার উপযুক্ত সময় মার্চ থেকে মে। এই সময় ঠান্ডা ভালই থাকে, তাই
উপযুক্ত শীতবস্ত্র নেওয়া উচিত। আবার বর্ষা বাদ দিয়ে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর।
জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে শীত বেশি, বরফ পড়ে।
কোথায় থাকবেন
কেএমভিএন-এর গেস্ট হাউস ছাড়াও কিছু বেসরকারি হোটেল আছে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.