সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ গণ্য না-করার যে-রায় ইতিপূর্বে দিল্লি হাইকোর্ট দিয়াছিল, কেন্দ্রীয় সরকার অবশেষে তাহা শিরোধার্য করার কথা সুপ্রিম কোর্টকে জানাইয়াছে। এই মর্মে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিগোষ্ঠীর যে সিদ্ধান্ত হইয়াছে, তাহা যে যৌনাচরণের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর পছন্দের স্বাধীনতাকে স্বীকার করিয়া লইতেছে, ইহা সামাজিক আচরণ ও মূল্যবোধের বিবর্তনের সহিত সরকারি অবস্থানের সামঞ্জস্যপূর্ণতার সূচক। কিন্তু এই প্রসঙ্গে মাননীয় বিচারপতিরা যে বিষয়টি লইয়া বৃহত্তর সামাজিক বিতর্কের প্রয়োজনীয়তার দিকে নির্দেশ করিয়াছেন, তাহাও প্রণিধানযোগ্য। তাঁহারা যথার্থই প্রশ্ন তুলিয়াছেন, কেন কেবল দুই বা চারি জন বিচারপতির এজলাসেই এ-সংক্রান্ত আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকিবে, কেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসভা বিষয়টি লইয়া বিতর্ক ও আলোচনান্তে আইন সংশোধন করিবে না?
অ্যাটর্নি জেনারেল বলিয়াছেন, ভারতীয় সমাজ এখনও সমকামিতা লইয়া প্রকাশ্য বিতর্ক ও আলোচনায় সঙ্কোচ বোধ করিবে। প্রশ্ন হইল, কেন? যখন বিষমকামের মতোই সমকামও ভারতীয় সমাজেই স্মরণাতীত কাল হইতেই আচরিত, অনুশীলিত হইয়া আসিতেছে, তখন সেই সামাজিক বাস্তবতা লইয়া জনপ্রতিনিধিরা প্রাসঙ্গিক আলোচনায় দ্বিধাগ্রস্ত কেন? ১৮৬০ সালের আগে সমকাম তো অপরাধ বলিয়া এ দেশে গণ্যই হইত না। প্রতারণামূলক ভিক্টোরীয় মূল্যবোধে আচ্ছন্ন ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় প্রজাদের উপর এই ধারণাটি চাপাইয়া দেয়। অন্যান্য অনেক সাম্রাজ্যবাদী আইনের মতো এই বৈষম্যমূলক আইনও অনেক আগেই রদ করা, নিদেনপক্ষে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৭ অনুচ্ছেদটি সংশোধন করা উচিত ছিল। সমাজ এখনও যথেষ্ট আধুনিক হয় নাই, এই অজুহাতে দেড়শো বছরের পুরানো একটি আইন চালু রাখা এবং সে জন্য চারিদিকে নিন্দা ও ধিক্কারের সম্মুখীন হইয়া পরিষদীয় উদ্যোগ এড়াইতে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া নির্লজ্জ সুবিধাবাদ। এতদ্দ্বারা সরকার কার্যত প্রগতিশীল আইন প্রণয়নে আপন দায়িত্বই এড়াইয়া চলিতে চাহিয়াছে। সেই সঙ্গে আইনসভায় বৈষম্যমূলক আইনটির সংশোধন যে প্রবল বিতর্ক ও কোলাহল উৎপন্ন করিত, তাহাকেও পাশ কাটাইতে চাহিয়াছে। অথচ সমকামিতার অধিকারকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে যথার্থ বিতর্কই প্রয়োজন। উন্নত দুনিয়ায় এই প্রক্রিয়াতেই সমকামের অধিকার আইনি স্বীকৃতি পাইয়াছে।
বিতর্ক, মতপার্থক্য, মতান্তরের ভয়ই (সম্ভবত সরকার পড়িয়া যাওয়ার ভয়ও) এ ভাবে আদালতের খিড়কির দরজা দিয়া সমকামিতাকে আইনগত স্বীকৃতি আনিয়া দিতে সরকারকে প্ররোচিত করিতেছে। গণতন্ত্রে কিন্তু এ ধরনের বিতর্কই প্রয়োজন। প্রয়োজন যে কোনও বিতর্কিত বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা, মতবিনিময়। মহিলাদের জন্য সংসদে আসন সংরক্ষণের মতো বিষয়ে যেমন রকমারি পরিষদীয় কৌশল ও পদ্ধতির আশ্রয় লইয়া দেশবাসীকে একই সঙ্গে শাসকের অভিপ্রায় এবং অপারগতার কথা সুকৌশলে জানানো হইয়া থাকে, সেটা কোনও সৎ শাসনপ্রণালী নয়। শাসক দল যদি মনে করে, নারীর সমানাধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য মহিলাদের সংরক্ষণ জরুরি, তবে প্রতিটি লোকসভায় এক বার করিয়া সংশ্লিষ্ট বিলটি পেশ করিয়া সিলেক্ট কমিটির হিমঘরে পাঠাইবার পরিবর্তে দৃঢ়তার সহিত তাহা লইয়া অগ্রসর হওয়া উচিত। সমকামিতাকে বিষমকামিতার মতোই স্বাভাবিক যৌনাচরণ মনে করিলেও একই ভাবে সংসদে তাহা লইয়া আলোচনার সূত্রপাত করা উচিত, যাহাতে সংসদই সংশ্লিষ্ট আইনটি সংশোধন বা রদ করিতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের তিরস্কার তাই যুক্তিপূর্ণ। |