দুইটি দেশ মানে যে কেবল দুইটি রাষ্ট্র, দুইটি সরকারই নয়, প্রকৃতপক্ষে দুইটি মূল্যবোধ, দুইটি বিশ্বদর্শনও বটে ভারত ও নরওয়ের সাম্প্রতিক সংঘাত তাহা স্পষ্ট করিয়া দেয়। দুই শিশুর দায়িত্ব লইয়া একটি জটিল সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে, তাহাতে কাহার কী পরিমাণ দায়িত্ব, এখনও অস্বচ্ছ। একটি বিষয়ে কিন্তু অস্বচ্ছতার কোনও স্থানই নাই, তাহা হইল পারিবারিক ও সামাজিক জীবনযাপন বিষয়ে দুই দেশের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ চিন্তাধারা। ভারতে এখন একটি অতিজাতীয়তাবাদী নির্ঘোষ বহুলশ্রুত হইতেছে যে নরওয়ের রাষ্ট্র কেমন আত্যন্তিক আসুরিক যাহা ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিসরেও অনুপ্রবেশ করিয়া তাহার দীর্ঘ নাসিকাটি গলাইতে পারে। সমস্যা হইল, জাতীয় আবেগে আপাদমস্তক ঋদ্ধ এই সমালোচকরা ভুলিয়া যাইতেছেন যে এই বিশেষ পরিবারটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ও সাক্ষ্যসাবুদ কিন্তু নরওয়ের সরকার আনে নাই, আনিয়াছে সে দেশেরই অসরকারি সংগঠন। তবে, সঙ্গে সঙ্গে ইহাও সত্য যে এই অসরকারি সংগঠন ও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষ তফাত নাই। সেই দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? তাহা হইল শিশুসন্তান কেবল মা-বাবার নিজস্ব সম্পত্তি নয়, শিশু নিজেই এক জলজ্যান্ত নাগরিক, আকারে ক্ষুদ্র হইলেও তাহার অধিকার সম্পূর্ণ ও অনতিক্রম্য, সুতরাং অন্যান্য নাগরিকের মতো তাহারও সেই নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। কোথাও সেই শিশুর অধিকার যদি লঙ্ঘিত হয়, তবে তাহার প্রতিকার করা রাষ্ট্রেরই গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। অধিকার, এমনকী শিশু-অধিকার বিষয়ে এই সংবেদনশীলতা সে দেশের (এবং আরও অনেক উন্নত দেশের) সংস্কৃতিতে অত্যন্ত গভীরপ্রসারী। কেবল রাষ্ট্রের ক্ষমতার অতি লম্বা হস্ত বলিয়া ইহাকে কোনও মতেই উড়াইয়া দেওয়া যায় না।
তবে উড়াইয়া দিবার প্রবণতাটি কোথা হইতে আসে তাহা বোঝাও আর একটি জরুরি কাজ। যে ভারতীয় মানসে শিশুদ্বয় বিষয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্বেগ এক আশ্চর্য অন্যায় হিসাবে প্রতিভাত হয়, সেই ভারতীয়তাই কিন্তু আরও অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রিক দায়িত্ব কিংবা নজরদারি স্বাভাবিক ও বাঞ্ছনীয় বস্তু বলিয়া স্বীকার করা হয়। কিন্তু পরিবার তাহার অন্তর্গত নহে। কেননা, সেই পরিবারে ‘অধিকার’-এর সংজ্ঞাটি যত কম প্রবিষ্ট হয়, ততই সেই ভারতীয়তার মঙ্গল। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি এ দেশে এখনও আদ্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক, ক্ষমতাতান্ত্রিক, যেখানে নারী ও শিশু নামক সংখ্যালঘু সদস্যরা কেবলই প্রান্তিক ও অনুল্লেখযোগ্য। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বৃহৎ পরিবার ভাঙিয়া অণু-পরিবার হইয়াছে, জেঠা-কাকা-দিদা-মাসি-পিসির বদলে শিশুসন্তান কেবল বাবা-মায়ের সম্পত্তি হিসাবে চিহ্নিত হইয়াছে, পাড়া ও সমাজের ভাঙন ধরিয়াছে, পাশের বাড়ির স্নেহশীল দাদু বা মামা-মাসিরাও উধাও হইয়াছেন। কিন্তু এত পরিবর্তনেও ক্ষমতাতন্ত্র যেহেতু এক চুলও পাল্টায় নাই, তাই পারিবারিক দুর্যোগ কিংবা অত্যাচারের ক্ষেত্রে প্রতিকারের ব্যবস্থাও কিছু তৈরি হয় নাই। আপাতত ভারত কিংবা নরওয়ে, উভয় দেশেরই সমাজে এক দিকে রাষ্ট্র, অন্য দিকে অণু-পরিবার, মাঝখানে বিস্তীর্ণ শূন্যতা। কিন্তু পার্থক্য এই যে এক দেশে রাষ্ট্র ও পরিবারকে সেই শূন্যতার মধ্যেও শক্ত করিয়া বাঁধিয়া রাখে অধিকার ও অধিকারভঙ্গের স্পষ্ট নিয়মকানুন, আর অন্য দেশটিতে কোনও নিয়মনীতির বালাই নাই, ছন্নছাড়া বেনিয়মি জীবনযাপনে পূর্বের সামাজিক ভরগুলিও গত হইয়াছে, আবার নতুন ভরের ভিত্তি হিসাবে আইনশৃঙ্খলার ব্যবস্থাও বিকশিত হয় নাই। সুতরাং পারিবারিক জীবনে যদৃচ্ছ অসাম্য ও অনাচারের আনাগোনা। পরিবার-সদস্যদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ অনারব্ধ, অনুপলব্ধ। |