দশ ঘণ্টার যুদ্ধে হেরে নিঃস্ব হাতিবাগান
মকলের লাইসেন্স নেই। ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হয়ে গিয়েছে বহু আগে। এমনকী, দমকলের সুপারিশ অনুযায়ী জলাধারও তৈরি করেননি কর্তৃপক্ষ।
‘নেই রাজ্যের’ হাতিবাগান বাজার তাই বৃহস্পতিবার ভোরে পুড়ে গেল দমকল আসার আগেই। জলাধার থাকলে অন্তত এ ভাবে আগুনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হত না দেড়শো বছরের পুরনো বাজারকে।
আগুন লেগেছিল বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ। দশ ঘণ্টা পরে বেলা দেড়টা নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পরে দেখা গেল, বাজারের ফলপট্টি, আলুপট্টি, চালপট্টি, সবজিপট্টি, শাড়িপট্টি, ফুলপট্টি, তেলপট্টি, মাছপট্টির কোনও অস্তিত্বই আর নেই। বাসনপট্টির দোকানগুলিও পুড়ে ছাই। ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে তোবড়ানো, কালো হয়ে যাওয়া বাসন। ওই বাজারে যে অংশে
ছিপ-বঁড়শি বিক্রি হত, পুড়ে গিয়েছে তা-ও। পূর্ব ও দক্ষিণ দিকের কয়েকটি দোকান ও অফিসঘর ছাড়া গোটা বাজারটাই পুড়ে গিয়েছে। দমকলের ৩২টি ইঞ্জিন দশ ঘণ্টার যুদ্ধের পরে যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনল, তখন পোড়া কাঠামো ছাড়া বাজারের পশ্চিম আর উত্তর দিকে কিছুই বেঁচে নেই। আর বাজারের মাঝখানে যে ঘেঁষাঘেঁষি করে এত দোকান ছিল, তা বোঝার উপায় নেই।
চলছে আগুন নেভানোর চেষ্টা। বৃহস্পতিবার হাতিবাগানে। সুমন বল্লভের তোলা ছবি।
সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ স্মৃতি রয়েছে কলকাতাবাসীর। বুধবার এসএসকেএম বা গত ডিসেম্বরে আমরির অগ্নিকাণ্ড এখনও দগদগে। চার বছর আগে মাঝরাতের আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল নন্দরাম মার্কেট। এবং ঘটনাচক্রে আজ, শুক্রবার স্টিফেন কোর্ট অগ্নিকাণ্ডের দু’বছর পূর্ণ হচ্ছে।
এত কিছুর পরেও শহরের সম্বিৎ ফিরেছে কি না, সেই প্রশ্নই তুলে দিয়ে গেল হাতিবাগান বাজারের আগুন। যে অগ্নিকাণ্ডের পরে দমকল যথাবিধি শ্যামপুকুর থানায় তিন মালিক পরিবারের নামে বিধি না মানার দায়ে জামিন অযোগ্য ধারায় এফআইআর দায়ের করেছে। পুলিশও সকালে মালিক পরিবারের অন্যতম সদস্য প্রতুল সাহাকে আটক করেছে। প্রতুলবাবুর বাড়ি চক্রবেড়িয়া রোড এলাকায়। তাঁর দুই ভাই প্রশান্ত সাহা, সুব্রত সাহার খোঁজ চলছে। ওই বাজারের আরও দুই কর্ণধার হলেন বিমল বণিক এবং নীলাম্বর মল্লিক। বিমলবাবু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নীলাম্বরবাবুকেও খুঁজছে পুলিশ। কিন্তু এর পরেও বাজারগুলি বিধি আদৌ মেনে চলবে কি না, সেই প্রশ্ন রয়েই গেল।
এর মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে চাপান-উতোর। এমনকী, অগ্নিকাণ্ডের পিছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে, এই অভিযোগও উঠেছে ব্যবসায়ী মহল থেকে।
হাতিবাগান বাজার পরিদর্শনে মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।
দমকল নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ কম নয়। তাঁদের বক্তব্য, আগুন লাগার এক ঘণ্টা পরে, সাড়ে চারটে নাগাদ দমকল ঘটনাস্থলে আসে। তারা যদি ঠিক সময় আসত, তা হলে পরিস্থিতি অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত। এই অভিযোগে এক সময়ে দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে বিক্ষোভও দেখান তাঁরা। তবে দমকল বলছে, তারা চারটে পাঁচে আগুন লাগার খবর পেয়েছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পাঁচটি ইঞ্জিন রওনা দেয় সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে। দমকল-কর্তাদের পাল্টা অভিযোগ, বাজারের নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলে প্রাথমিক ভাবে লড়াই চালানো যেত আগুনের সঙ্গে। দমকলমন্ত্রী বলেন, “দেরিতে পৌঁছনোর অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” দমকলের ডিজি দুর্গাপ্রসাদ তারানিয়া বলেন, “ওই বাজারে অগ্নি-সুরক্ষার বিধি মেনে উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল না। তাই আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে।” তিনি জানান, বাজার-সংলগ্ন এলাকায় জলের জোগান কম থাকায় দমকলের কাজ করতে অসুবিধা হয়েছে। স্টার থিয়েটার ও হেদুয়া পার্ক থেকে রিলে সিস্টেমে জল এনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়।


হাতিবাগান
হাতিবাগানের নামের ইতিহাস নিয়ে দু’টি মত প্রচলিত আছে।
একটি মতে
১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা আক্রমণ করার সময় সিরাজদ্দৌলা ঘাঁটি গেড়েছিলেন হালসিবাগানে উমিচাঁদের বাগানবাড়িতে। তাঁর হস্তিবাহিনীকে রাখা হত এই অঞ্চলে। সেখান থেকেই অঞ্চলটির নাম হয়েছে ‘হাতিবাগান’।
------------------------------------
অন্য মতে
সিরাজদ্দৌলার হস্তিবাহিনী ছিল এন্টালি অঞ্চলের হাতিবাগানে। শ্যামবাজার অঞ্চলের হাতিবাগানের নাম হয়েছে হাতি-পদবিধারী কোনও এক ব্যক্তির বাগানবাড়ি থেকে। পরে ওই বাগানবাড়ি ও সন্নিহিত অঞ্চল তাঁর কাছ থেকে কিনে নেন মহতাবচাঁদ মল্লিক। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি তিনিই সেখানে বাজারের পত্তন করেন।

তথ্যসূত্র: হরিপদ ভৌমিক

আগুন লাগার পরে গোটা বাজার যখন জ্বলছে, তখনই জানা যায়, বেসরকারি মালিকানার ওই বাজারের দমকলের লাইসেন্স নেই। বিধি না মানায় কলকাতা পুরসভা ট্রেড লাইসেন্সও বাতিল করে দিয়েছে বহু দিন আগেই। জলাধার তৈরি নিয়ে দমকলের সুপারিশও মানা হয়নি। কোনও নিয়ম না মেনে এই বাজার কী ভাবে চলছিল, তা নিয়ে দমকল, পুরসভার কর্তারা সবাই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাওয়া, দমকলের ছাড়পত্র না-থাকা সত্ত্বেও বাজার কী ভাবে চলে, এই নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা দেখার দায়িত্ব যাঁদের উপরে, সেই পুরসভা ও দমকল-কর্তারা মুখে কুলুপ আঁটেন। ব্যবসায়ীরাও এ ব্যাপারে বাজার-কর্তৃপক্ষের উপরে কখনও চাপ দেননি। আগুন লাগার পরে এ দিন সকালে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে চাপান-উতোরে জড়িয়ে পড়েছেন পুর-কর্তা, দমকল-কর্তা এবং ব্যবসায়ীরা। মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ বলেন, “বাজারের উন্নয়নে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওই বাজারের তিন মালিক ও একটি ব্যবসায়ী সমিতির মধ্যে সমন্বয় না থাকায় কোনও কাজ করা যায়নি।”
আগুন লাগল কী ভাবে? দমকলের প্রাথমিক অনুমান, শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগে। এবং তা লাগে বাজারের ফলপট্টির (শুকনো ফল) কোনও অংশে। দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানও বলেন, “বাজারের চার দিকে বিদ্যুতের তার ছড়িয়ে ছিল। সেখান থেকেই আগুন লাগতে পারে।” পুলিশ সূত্রের খবর, বাজারের বিভিন্ন অংশে কয়েকটি বেআইনি গুদাম ছিল। ওই সব গুদামে ছিল প্রচুর দাহ্য পদার্থও। তাতেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তেল, সবজি, মাছ, বাসন, আলু, চাল, কাপড়পট্টিতেও। বৃহস্পতিবার বিকেলে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে যান। তবে ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন, “আগুন সব প্রমাণ গ্রাস করে নিয়েছে। যা বাকি ছিল, তা জলে ধুয়ে গিয়েছে। তাই তদন্ত করে কী লাভ?” ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ষড়যন্ত্র করে আগুন লাগানো হয়েছে। ঘটনায় জড়িত বাজারের মালিকপক্ষ। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তদন্ত হবে। হাতিবাগান বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক অভিজিৎ সাহা বলেন, “১০ মিনিটে গোটা বাজারে আগুন ছড়িয়ে যায়। একসঙ্গে কয়েকটা দিকে আগুন জ্বলছিল। আগুন লাগানো না-হলে এমন হতে পারে না।” সংগঠনের সদস্য সমরেশ দত্ত, তারকনাথ দাসের অভিযোগ একই। তাঁদের বক্তব্য, বাজার সংস্কার, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা তৈরি-সহ বিভিন্ন বিষয়ে মালিক পক্ষের সঙ্গে বারবার আলোচনা করেও লাভ হয়নি। বাজারের জমিতে বহুতল তৈরির চক্রান্ত চলছে।

সময় নিয়ে বিভ্রান্তি
------------------------------------------------
------------------------------------------------

*মেয়র পারিষদ

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছ থেকে জেনেছি, ৪-৫ জন যুবক ঘোরাফেরা করছিল। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হবে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি হবে।” মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “শহরের বিভিন্ন বেসরকারি বাজার রক্ষীবিহীন। সরকারি, বেসরকারি সব বাজারেরই নিরাপত্তার দিকটা সবাইকে নজরে রাখতে হবে। চক্রান্ত করে কেউ আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। তাতে ক্ষতি হবে ব্যবসায়ীদেরই। পুরসভা এ ঘটনার তদন্ত করবে। মানবিকতার জন্য ক্ষতিপূরণের বিষয়ও ভেবে দেখবে সরকার। বাজারটির পুনর্গঠন নিয়ে মেয়রের সঙ্গে কথা বলব।”
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ঘটনাস্থলে গিয়ে বলেন, “এই ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত চাই। আর দমকল কেন দেরিতে এল, তা নিয়ে বিধানসভায় সরব হব।”
তবে যাঁদের সর্বস্ব গিয়েছে, তাঁদের কাছে এ দিন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের চাপান-উতোর কার্যত অর্থহীন ছিল। বাসনের দোকানদার অমরনাথ শ্রীবাস্তব বুধবার রাতে তাঁর দোকানেই শুয়েছিলেন। তিনি বলেন, “পোষা কুকুরের চিৎকারে ভাগ্যিস মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। তখনই ধোঁয়ায় ভরে ছিল চারপাশ। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। দোকানের দরজা খুলতেই দেখি দাউদাউ আগুন।” অমরনাথবাবু বলেন, “দোকানের কাছেই একটা গেট। সে দিকে ছুটে গিয়ে দেখি তা তালাবন্ধ। অন্ধকার, ধোঁয়ায় দেখতেও অসুবিধা হচ্ছিল। অন্য গেটের সামনে গিয়ে দেখি, সেটাও তালাবন্ধ। ভুলেই গিয়েছিলাম, রাতে মূল প্রবেশ পথ ছাড়া অন্য সব গেট বন্ধ থাকে। বাতাস থাকায় মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে। বাঁচার জন্য ভেঙেই ফেললাম গেটের তালা। সঙ্গে বেরিয়ে এলেন আরও কয়েক জন।” রাতে বেশ কয়েকটি দোকানে কর্মচারীরা থাকেন। থাকেন মুটিয়ারা। তালা ভেঙে সবাই অবশ্য বেরিয়ে আসতে পেরেছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তবে পাঁচ জনের আহত হওয়ার খবর মিলেছে। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক অভিজিৎবাবু বলেন, “চৈত্র মাসে মহাজনের টাকা মেটানোর জন্য অনেকেই নগদ টাকা এনে বাজারের বিভিন্ন সিন্দুকে রেখেছিলেন। সব পুড়ে গিয়েছে।” সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.