কূটনৈতিক তৎপরতায় যতটা এগোনো গিয়েছিল, নরওয়ে থেকে প্রবাসী বাঙালি দম্পতির দুই শিশুসন্তানকে দেশে ফেরানোর বিষয়টি এখন প্রায় ততটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। অনুরূপ ও সাগরিকা ভট্টাচার্যের ছেলেমেয়েদের তাদের কাকার হাতে তুলে দেওয়া হবে না বলে আজ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন নরওয়ে কর্তৃপক্ষ। তাঁদের বক্তব্য, গত ক’দিন ধরে ওই দম্পতির ক্রমাগত পরস্পরবিরোধী মন্তব্যের জেরেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিশুদু’টির ভবিষ্যৎ নিয়ে আগামিকাল নরওয়ের আদালতে যে শুনানি ছিল, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা-ও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ওই দুই শিশু, অভিজ্ঞান ও ঐশ্বর্যার বাবা অনুরূপ বলেছিলেন, তাঁর স্ত্রীর মানসিক সমস্যা রয়েছে এবং এর ‘শিকার’ হতে হয় তাঁকেও। যদিও পরে সে কথা অস্বীকার করেন অনুরূপ। আজ আবার সাগরিকা তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ এনেছেন। সাগরিকার কথায়, “অনুরূপ আমার উপর অত্যাচার করত। আমার ফোন থেকে সমস্ত নম্বর মুছে দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দেয়। গত সোমবার থেকে আমি বন্ধুর আশ্রয়ে রয়েছি।”
অনুরূপ তাঁকে একটি চুক্তিতে সই করার জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিলেন বলেও দাবি করেছেন সাগরিকা। তিনি জানান, ওই চুক্তিতে লেখা ছিল, তিনি এবং অনুরূপ আলাদা হয়ে গেলে বা তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হলে অভিজ্ঞান ও ঐশ্বর্যা তাদের কাকা কিংবা অন্য কোনও আত্মীয়ের কাছে থাকবে, এবং সাগরিকা, অনুরূপ বা তাঁদের কোনও আত্মীয় ওই চুক্তির বিরোধিতা করে আদালত বা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে পারবেন না। সাগরিকার দাবি, তিনি এই চুক্তিতে সই করতে রাজি না হওয়ায় অনুরূপ তাঁকে বলেছিলেন, ভাইয়ের সঙ্গে ছেলেমেয়েকে ভারতে পাঠিয়ে দেবেন। সাগরিকা বলেছেন, এই সময়ে সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাট তাঁকে ওই চুক্তিতে সই করতে বারণ করেন। যদিও অনুরূপ তাঁকে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, এ কথা অস্বীকার করেছেন সাগরিকা। গোটা ঘটনাটিকে ‘অতিরঞ্জিত করা হচ্ছে’ বলে এর আগে দাবি করেছিলেন সাগরিকার বাবা। এখন কিন্তু সাগরিকার মা এবং তিনি তাঁদের জামাইকে দুষেছেন। বলেছেন, মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁরা এতটাই চিন্তিত যে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে মেয়েকেও তাঁরা দেশে ফিরিয়ে আনতে চান।
গত কাল ভারতীয় দূতাবাসের এক কূটনীতিকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন অনুরূপ ও তাঁর ভাই অরুণাভাস। আগে অরুণাভাস জানিয়েছিলেন, তিনি ওই দুই শিশুর দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। যদিও পরে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যেতে শুরু করেন। গত কাল কিন্তু ওই কূটনীতিকের কাছে অনুরূপ বলেন যে, তাঁর ভাই অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যার দায়িত্ব নিতে রাজি। এবং তিনি নিজে তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে যে সব মন্তব্য করেছিলেন, তা প্রচণ্ড মানসিক চাপ থেকেই করেছিলেন।
২০১১-র মে মাস থেকে নরওয়ের শিশু কল্যাণ সমিতির তত্ত্বাবধানে রয়েছে অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যা। শেষ পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে, আপাতত সে সিদ্ধান্ত অথৈ জলে। শিশুকল্যাণ সমিতির প্রধান গুনার টোরেসেন বলেন, “গত কয়েক দিনে অনুরূপ, সাগরিকা ও অরুণাভাস এত বার এত রকম কথা বলছেন যে, তাঁদের সঙ্গে কোনও চুক্তিতে যেতে ভরসা পাচ্ছি না আমরা। এর ফলে বাচ্চাগুলোই দড়ি-টানাটানির মধ্যে পড়ে যাবে। সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হবে।” উদ্বেগের আরও একটি কারণ ব্যাখ্যা করেন অনুরূপ-সাগরিকার আইনজীবী শ্বেন শ্বেন্ডসেন। পুরনো একটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি জানান, আট বছর নরওয়েতে থাকা সত্ত্বেও ভিসা শেষ হয়ে যাওয়ায় এক বার ইথিওপিয়ার দু’টি শিশুকে দেশে ফিরতে বাধ্য করেছিল নরওয়ে সরকার। অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যার রেসিডেন্স পারমিট শেষ হবে মার্চেই। তার পরেও তারা নরওয়েতেই থাকবে, নাকি ইথিওপিয়ার শিশুগুলির মতো হঠাৎ কোনও দিন তাদের দেশে ফিরতে বাধ্য করা হবে, এই সব নিয়েই সংশয়ে ওই আইনজীবী। |