চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
‘মিথ’ হয়ে বিজ্ঞাপনও নিয়ন্ত্রণ করে জীবনকে
বাজার-অর্থনীতি এখন প্রায় বিশ্বব্যাপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের বড় বা মাঝারি শহরে তার চেহারা বা চরিত্র অনেকটাই এক রকম। সংস্কৃতিগত আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য মুছে যাচ্ছে। জীবনযাপন বা ব্যবহৃত পণ্যের প্রকৃতি হয়ে উঠছে অনেকটাই এক রকম। এর সবচেয়ে প্রকৃষ্ট প্রকাশ দেখা যায় বিজ্ঞাপনের চরিত্রে। বিজ্ঞাপন পণ্যের বিপণনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। বিশ্বায়নের যুগের ধনতন্ত্রে এই বিজ্ঞাপন সর্বগ্রাসী রূপ নিচ্ছে। তা জীবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। বিজ্ঞাপন হয়ে উঠছে একটা ‘মিথ’ বা অতিকথার মতো।
সেই অতিকথার চাপে জীবন কেমন করে বিপর্যস্ত হয়, সেটাই সম্ভবত দেখাতে চেয়েছেন অনির্বাণ ঘোষ স্টুডিও ২১-এ অনুষ্ঠিত তাঁর একক প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীর শিরোনাম- ‘মিথোলজিজ: দ্য মিনিং অব দ্য সাইনস’।
মূলত ফোটোগ্রাফি, ইনস্টলেশন ও ভিডিওর মাধ্যমে উপস্থাপিত এই প্রদর্শনীতে শিল্পী বিজ্ঞাপনকেই মূল উপজীব্য করেছেন। এই বিজ্ঞাপন কেমন করে ‘মিথ’ হয়ে উঠে সমগ্র জীবনের মধ্যে ছড়িয়ে যায়, জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, প্রায় সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে তারই নানা আলেখ্য গড়ে তুলেছেন প্রচলিত চিত্রভাষার বাইরে গিয়ে বিকল্প শিল্প-আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে।
অনির্বাণ এই বিজ্ঞাপনকে, বিজ্ঞাপনের অন্তর্গত ‘মিথ’ বা অতিকথাকে নানা ভাবে তুলে ধরেছেন। কখনও নির্লিপ্ত ভাবে আবার কখনও বা তার মধ্যে এনেছেন শ্লেষ। কখনও তীব্র প্রতিবাদী চেতনা। ১৯৯০-এর দশকে বাজার অর্থনীতি আমাদের দেশে প্রবেশের পর থেকে দৃশ্যকলার ভিতর দিয়ে নানা ভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। তখন থেকেই প্রথাগত চিত্র-ভাস্কর্যের পাশাপাশি বিকল্প শিল্পমাধ্যমের বিকাশ ঘটতে থেকেছে। এই ‘অলটারনেটিভ আর্ট’ বা বিকল্প মাধ্যমের মূল প্রবণতা পাশ্চাত্য নিয়ন্ত্রিত।
শিল্পী: অনির্বাণ ঘোষ
এখন যাকে আমরা আন্তর্জাতিক বলি, সেটা প্রথম বিশ্বের ক্ষমতাকেন্দ্রেরই প্রকাশ মাত্র। অনির্বাণের কাজের মূল প্রবণতাকে বলা যেতে পারে পাশ্চাত্য-কেন্দ্রিক। তিনি অবশ্য দেখিয়েছেন, সেই পাশ্চাত্য-নিয়ন্ত্রিত ‘মিথ’ কেমন করে আমাদের দেশের জীবনযাপনকে পর্যুদস্ত করছে।
হিউমার ইন সেক্স’ শিরোনামে তাঁর ইনস্টলেশন প্রজেক্ট-এর কথাই ধরা যেতে পারে। তার সঙ্গে একটি ভিডিও-ও রয়েছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে শহরের রাস্তায় সাধারণ জীবনপ্রবাহ। যেমন আমরা প্রতিনিয়ত দেখে থাকি। তার ভিতর দিয়ে মাঝেমাঝেই দু’টি বিশাল আকৃতির সানগ্লাস বাহিত হচ্ছে। এই সানগ্লাসকে শিল্পী একটা প্রতীক করে তুলেছেন। শুধু একটি বড় ভাস্কর্যসুলভ ত্রিমাত্রিক সানগ্লাস মেঝেতে স্থাপন করেও একটি ইনস্টলেশনধর্মী রচনা করেছেন।
আবার দেয়ালে দু’টো বোর্ডে সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো রয়েছে অজস্র সানগ্লাস, এরকম একটি প্রদর্শও রয়েছে প্রদর্শনীতে। সানগ্লাস এখানে উন্নততর নাগরিক জীবনযাপনের অন্তঃসারশূন্যতার প্রতীক। এর সঙ্গে শিল্পী যৌনতার একটা সম্পর্কও স্থাপন করেছেন।
আর একটি ইনস্টলেশনে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বিপণন কেন্দ্রে যে সব নির্দেশিকা ঝোলানো থাকে, যেমন ‘ফিক্সড প্রাইস’, ‘নো ক্রেডিট’, ‘ফায়ার এক্সিট’, ‘লেডিজ’, ‘জেন্টস’ ইত্যাদি লাল অক্ষরে লেখা সে রকম কিছু নির্দেশিকা উপর থেকে যূথবদ্ধ ভাবে শূন্যে ঝুলছে। এই রচনাটিতে এমন কিছু দৃশ্যময়তা নেই যা নান্দনিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। শিল্পী যদি প্রচলিত বা প্রথাগত নান্দনিকতার ধারণাকে ভাঙতে চান, সেটা একটা তাৎপর্য হয়ে উঠতে পারে। আধুনিকোত্তর শিল্প ভাবনায় নান্দনিকতার স্বরূপ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
বরং শিল্পী আর এক ধরনের গভীরপ্রসারী নান্দনিকতা তৈরি করেছেন তাঁর ‘এমপায়ার্স স্টেটস মাইগ্রেশন’ সিরিজের কয়েকটি রচনায়। ভিনাইলের উপর ছাপ তোলা এই ডিজিটাল প্রিন্টধর্মী রচনাগুলিতে মাধ্যমের ভিন্নতা সত্ত্বেও প্রথাগত চিত্রের একটা অনুষঙ্গ গড়ে ওঠে, যার ভিতর দিয়ে বিপণন-নির্ভর এই জীবনযাপনের অন্তর্নিহিত করুণ শূন্যতা আভাসিত হয়। এ দিক থেকে চতুর্থ ছবিটির দৃশ্যময়তা ও দৃশ্যগত নান্দনিকতা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দু’টো কালো বৃহদাকার মুখোশ উপস্থাপিত হয়েছে চিত্রপটে, যার ভিতর রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক আদিমতার অভিব্যক্তি। দু’টো গাছ। দু’টো কালো চেয়ার। তার তলায় কিছু কাক। এ সমস্ত প্রতিমাকল্পের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে যে দৃশ্যময়তা তাতে ধনতন্ত্রের ‘মিথ’কে ভাঙারও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.