|
|
|
|
পাড়ার কেউ চায়, কেউ চায় না |
সুদীপার মুখে কথা নেই, শিক্ষকের অপেক্ষায় স্ত্রী |
বিতান ভট্টাচার্য ও শুভাশিস ঘটক • কলকাতা |
কেউ বলছেন, “উনি বাড়ি ফিরে এলেই ভাল। ওঁর মতো শিক্ষক লাখে একটা মেলে।”
কারও আবার উল্টো মত, “শিক্ষক হিসেবে উনি যা করেছেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। ওঁর মুক্তি মন থেকে মানতে পারছি না।”
নোয়াপাড়ায় পালবাড়ির চার জনকে খুনের ঘটনায় দু’দশকেরও বেশি জেল খেটে মুক্তি পেতে চলেছেন মূল আসামি রণধীর বসু। তাঁর মুক্তির কথা শুনে বুধবার ইছাপুরের বাপুজিনগরে ওই শিক্ষকের পড়শিদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এমনই ক্ষমা-অক্ষমায় মেশানো।
রণধীর বসু। ফাইল চিত্র |
পালবাড়ির মেয়ে সুদীপার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার অঙ্ক ও বিজ্ঞানের শিক্ষক রণধীরবাবুর। কিন্তু সুদীপার পরিবার সেই সম্পর্ক মেনে নিতে চায়নি। ১৯৯১ সালে খুন হন পাল পরিবারের চার জন। বাবা-মা, ঠাকুরদা-ঠাকুরমাকে খুনের অভিযোগে ধরা পড়ে কিশোরী সুদীপা পাল। মূল অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার করা হয় রণধীরবাবুকে। পরে রাজসাক্ষী হওয়ায় খালাস পায় সুদীপা। চার খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় রণধীরবাবুর।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার যে-সব বন্দির মুক্তির তালিকা দিয়েছেন, তাতে রণধীরবাবুর নামও আছে। দু’দশক কারাবাসের পরে কয়েক দিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরবেন তিনি। সেই খবর শুনে কী বলছেন সে-দিনের কিশোরী সুদীপা?
সেই সুদীপা এখন বারুইপুর এলাকার একটি বাড়ির একতলার ভাড়াটে। এ দিন বিকেলে ওই বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের বা মাস্টারমশাই, কারও সম্পর্কে একটি কথাও বলতে চাননি তিনি। মাটির দিকে তাকিয়ে কঠিন মুখে বলে দেন, “এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।” তাঁর ছবি তুলতেও নিষেধ করেন সুদীপা। বারুইপুরের ওই পাড়ায় তাঁকে অবশ্য খুব বেশি লোকে চেনেন না। পুলিশি সূত্রের খবর, ভিন্ ধর্মে বিয়ে হওয়ার দরুন সুদীপা নামটা তাঁর বাড়িওয়ালারও জানা নেই। তবে ভাড়াবাড়িতে ওই মহিলা এখনও কার্যত একাই থাকেন বলে জেনেছে পুলিশ। এ দিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে ‘পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন’ বলে দরজা বন্ধ করে দেন সুদীপা। পরে দরজা খোলেন বোরখা পরে। কিন্তু তাঁর অতীত বা বর্তমান কোনও বিষয়েই একটি কথাও বলতে রাজি হননি তিনি।
সুদীপা কিছু না-বললেও স্বামীর ফেরার পথ চেয়ে আছেন এক প্রৌঢ়া। পলেস্তারা খসা, হাঁ-মুখ দেওয়াল, পলিথিনের জোড়াতালি দেওয়া ঘরে আসবাব বলতে একটা তক্তপোশ আর একটা প্লাস্টিকের চেয়ার। রং-চটা, ছোট একটি সিংহাসনে অসংখ্য ঠাকুর-দেবতার ছবি। চূড়ান্ত দারিদ্রের ছাপ ঘরের সর্বত্র। তরুণী মেয়েকে নিয়ে ওই বাড়িতেই স্বামীর পথ চেয়ে রয়েছেন রণধীরবাবুর স্ত্রী অলকাদেবী। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘আমার স্বামী সত্যিকারের শিক্ষক। ২১ বছর জেলে থেকেও অসংখ্য কৃতী ছাত্র তৈরি করেছেন। যিনি মানুষ গড়ার কারিগর, তিনি কখনও খুনি হতে পারেন না।’’ সুদীপার কথা বলতে গেলে এখনও চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে অলকাদেবীর। তিনি বলেন, ‘‘সুদীপা খুব একগুঁয়ে ছিল। ১৬ বছর বয়সেই কী জেদ! কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে যাবে, সঙ্গী মাস্টারমশাই। নতুন পোশাক কিনবে, তাতেও মাস্টারমশাইকে নিয়ে যাওয়া চাই। শেষ দিকে আমিই বিরক্ত হতাম। সুদীপাকে দু’-এক বার বকেওছিলাম ওর এই জেদের জন্য।’’
রণধীরবাবুর বাড়িটাকে পাড়ার সকলে চেনেন গদু মাস্টারের বাড়ি বলে। সেই গদু মাস্টারের মুক্তির খবর পেয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এলাকার মানুষের। স্থানীয় বাসিন্দা প্রণব বিশ্বাস বলেন, ‘‘খুব ভাল শিক্ষক। শিক্ষকতার জন্য জেলে থেকেও পুরস্কার পেয়েছেন। সুদীপা পালের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক বা খুনের ঘটনায় আইন অনুযায়ী যা সাজা হওয়ার, তা তো হয়েছেই। এই বৃদ্ধ বয়সে আর পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কী? সরকার ওঁকে মুক্তি দিয়েছে, এটাই ভাল খবর।’’ রণধীরবাবুর আর এক পড়শি বিজয় মুখোপাধ্যায়ের মত অবশ্য ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘‘এক জন শিক্ষক যে-ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, তার স্মৃতি এখনও দগদগে। কী করে চার জনকে খুনের মূল আসামিকে মুক্তি দেওয়া হল? আমরা কোনও বিরোধে যাব না। কিন্তু ওঁর মুক্তিটাও আমরা মন থেকে মানতে পারছি না।’
মুক্তির স্বাদ কেমন লাগছে তাঁর?
এ দিন লালাগোলা মুক্ত কারাগার থেকে রণধীরবাবু ফোনেবললেন, ‘‘ভাঙতে ভাঙতে কোনও রকমে বেঁচে আছি। মুক্তিটা একটু স্বস্তি দেবে। স্ত্রী আর মেয়ের কাছে থাকতে পারব। ওরা আমাকে পাশে চায়। এটাই তো পরম প্রাপ্তি। শিক্ষক ছিলাম। শিক্ষকই আছি।’’ লালগোলা মুক্ত কারাগারে রণধীরবাবুর জনা ১৫ জন ছাত্রছাত্রী আছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েক জন এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছেন। ছাড়া পাওয়ার পরে পরীক্ষার্থীদের সমস্যা হলে ফের ওই কারাগারে গিয়ে তাঁদের সাহায্য করতে চান মাস্টারমশাই। |
|
|
|
|
|