কলকাতাকে দিয়েই প্রায় ২০০ বছরের ‘ঐতিহ্য’ ভাঙতে চলেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৯ বছর আগে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা গড়ে তুলেছিলেন ‘অক্সফোর্ড ইউনিয়ন’ বিতর্ক সংস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের সীমানা ছাড়িয়ে এই প্রথম সেই সংস্থার কুশীলবেরা আসছেন বৃহত্তর জনসমাজে। আগামী শনিবার, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সঙ্গে তাঁরা তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। এর আগে কলকাতা কেন, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সাংহাই দুনিয়ার কোত্থাও তর্কসফরে যায়নি অক্সফোর্ড ইউনিয়ন।
এমনিতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ৮৪৫ বছরের পুরনো। প্যারিসের পরে দুনিয়ার দ্বিতীয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ৩৮টি কলেজের পড়ুয়া ছাড়া আর কেউ ওই ডিবেটিং ইউনিয়নের সদস্য হতে পারেন না। এবং শুধু পড়ুয়া হলেই হল না, রীতিমতো চাঁদা দিয়ে সদস্যপদ নিতে হয়। যত দিন গিয়েছে, সেই ‘অক্সন-আভিজাত্য’-এর ধার তত বেড়েছে। উনিশ শতকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন থেকে হাল আমলের ডেভিড ক্যামেরন, টনি ব্লেয়ার, প্রয়াত পাক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো, ভারতীয় যোজনা কমিশনের চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া অনেকেরই তার্কিক ব্যুৎপত্তি ছাত্রাবস্থায় ওই ‘অক্সফোর্ড ইউনিয়ন’ থেকেই শুরু।
সেই ‘ডিবেটিং ইউনিয়ন’ এ বার প্রথা ভেঙে অক্সফোর্ড-এর আইসিস নদীর তীর ছেড়ে হুগলি নদীর ধারে। ‘ব্যালান্টাইন’ ও ‘বিড়লা সান লাইফ’-এর সৌজন্যে।
বিতর্কের বিষয়? সভার মতে, কলকাতাকে লন্ডন থেকে আরও ভাল ভাবে শাসন করা যায়। অক্সফোর্ড ইউনিয়ন বলবে মতের বিরুদ্ধে, কলকাতার সমর্থনে। কোন দুঃখে কলকাতাকে শাসন করা হবে লন্ডন থেকে? ইউনিয়নের পাঁচ তার্কিক র্যাচেল অ্যালিস ক্রুক, ক্যাথরিন ব্রুক্স, জো ফ্যানন, হাসান ডিন্ডিগার ও ম্যাথু হ্যান্ডলি বৃহস্পতিবার রাতেই পৌঁছে যাচ্ছেন কলকাতায়। তার্কিকদের প্রথম তিন জন মহিলা। কলকাতার কাছে এই বিষয়ে লন্ডন, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ সকলের নীরব ঋণ রয়েছে। উনিশ শতকে কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, চন্দ্রমুখী বসু কলকাতা থেকে স্নাতক হওয়ার ঢের পরে ১৮৭৮ সালে অক্সফোর্ডে মেয়েদের কলেজ শুরু।
তবে, এই বিতর্ক-প্রস্তাব প্রতীক মাত্র। কলকাতার বিরুদ্ধে, লন্ডনের সমর্থনে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ দলের হয়ে যাঁরা গলা ফাটাবেন, তাঁরা কেউই লন্ডনের বাসিন্দা নন। ক্রিকেটার কপিল দেব থেকে সাংবাদিক স্বপন দাশগুপ্ত, বরখা দত্ত বা রাজনীতিক রাজীবপ্রতাপ রুডি সকলেই নিখাদ ভারতীয়।
কারণ, এই বিতর্কে কলকাতা বা লন্ডন শুধুই শহর নয়, আরও বেশি কিছু। নিছক উপনিবেশবাদ বা প্রাচ্যবিদ্যার দর্শনে এই কলকাতা-লন্ডনের ফারাক করা যাবে না। সব শহরের বুকেই হয়তো একই সঙ্গে সুশৃঙ্খল লন্ডন আর বিশৃঙ্খল কলকাতা লুকিয়ে থাকে। সুষ্ঠুসুন্দর গ্রিক দেবতা ‘অ্যাপোলো’র পাশেই তো থেকে যান সৌন্দর্যহীন মাতাল ‘ডায়োনিসাস’।
কী হবে বিতর্কের ফল? অক্সফোর্ড ইউনিয়ন ছেড়ে কথা বলে না। ইতিহাস জানে, ১৯৩৩ সালে অক্সফোর্ড ইউনিয়নের বিতর্কের প্রস্তাব: রাজা ও দেশের নামে আমরা যুদ্ধ করব না। জিতল সেই প্রস্তাব। পক্ষে ২৭৫, বিপক্ষে মাত্র ১৫৩ ভোট। তৎকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রনায়ক উইনস্টন চার্চিল সেই জয়কে ‘ঘৃণ্য, ন্যক্কারজনক’ ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করেছিলেন। চার্চিলের মুখে ঝামা ঘষে দেওয়া সেই তর্কশীলদের উত্তরসূরিরা শনিবার নেতাজি ইন্ডোরে কলকাতাকে কী ভাবে বাঁচান, এখন শুধু তারই অপেক্ষা! |