কৃষকের জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই মহাকরণে পৌঁছেছিলেন তিনি। মহাকরণে দাঁড়িয়ে সেই ‘রাজনৈতিক’ অবস্থানই বজায় রাখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কৃষক ঋণ শোধ করতে না-পারলেই তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না বলে জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তাঁর সাফ বক্তব্য, যে সমবায় আইনের বলে ঋণখেলাপি কৃষকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যায়, সেই আইনই তাঁরা সংশোধন করে ফেলবেন! মুখ্যমন্ত্রীর মতে, ওই আইনের ‘গোড়ায় গলদ’! তমলুকের একটি সমবায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ ঋণ অনাদায়ীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে বলে নোটিস দিয়েছিল। মহাকরণে সোমবার সেই নোটিস তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী যেমন তাঁর সরকারের নীতির কথা ঘোষণা করেছেন, তেমনই ওই সমবায়ের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হবে বলে জানিয়েছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় প্রশ্ন থাকল, এর পরে ঋণের বকেয়া আদায়ের কী হবে?
ঘটনাচক্রে, সমবায় ব্যাঙ্কের ঋণ আদায়ের জন্য নোটিস-বিতর্ক সেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়, যে জেলার নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের জন্য সাম্প্রতিক কালে গোটা দেশের নজরে এসেছে এবং তৃণমূল নেত্রী মমতার রাজনৈতিক পুনরুত্থানের সোপান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঘটনাচক্রে, পুলিশের গুলিচালনার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে কাল, বুধবারই যে নন্দীগ্রামে যাবেন মমতা! শুধু তা-ই নয়, এ বার থেকে ১৪ মার্চকে সরকারি ভাবে ব্লকে ব্লকে ‘কৃষক দিবস’ হিসেবে পালন করার কথাও ঘোষণা করেছেন তিনি। |
বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতার আন্দোলন ছিল কৃষকের জমি ‘ছিনিয়ে’ নেওয়ার বিরুদ্ধে। কৃষকের সম্পত্তি বলতে মূলত জমি এবং বাস্তুভিটেই বোঝায়। তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, অনাদায়ী ঋণের খেসারত হিসেবে সেই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নীতি মেনে নিতে অপারগ মুখ্যমন্ত্রী। বিষয়টি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের নিরিখে এতটাই ‘স্পর্শকাতর’ যে, সংশ্লিষ্ট আইন বদলে দেওয়ার কথাও বলেছেন মমতা। বিশেষত, পঞ্চায়েত ভোটের আগে কৃষকদের ‘পাশে থাকা’র বার্তা যেখানে তৃণমূল নেত্রীর কাছে ‘অত্যন্ত জরুরি’।
তমলুকের নোটিস প্রদানকারী ব্যাঙ্কের পরিচালন কর্তৃপক্ষ তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বই। তাঁদের বক্তব্য, আইন মেনেই ওই নোটিস জারি হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী ওই নোটিসকে ‘বেআইনি’ বলায় স্থানীয় নেতৃত্ব ‘বিস্মিত’ও। তবে মুখ্যমন্ত্রী আইনটিই সংশোধনের ঘোষণা করায় এই প্রশ্নও উঠছে যে, এর পরে কৃষকেরা দিনের পর দিন ঋণ বকেয়া রাখলে আদায়ের জন্য কী পথ খোলা থাকবে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের হাতে?
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন মহাকরণে বলেছেন, “সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনও কৃষকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না। গরিব মানুষ কখনও কখনও ঋণ শোধ না-করতেই পারেন। কিন্তু তা না-পারলেও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না।” মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, অনেক কিছুর মধ্যে ‘রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ’ ঘটেছে। বাম জমানায় ২০০৬ সালের যে আইনবলে ওই সমবায় ব্যাঙ্ক এ রকম কাজ করতে চেয়েছে, তা তাঁর সরকার ‘অনুমোদন’ করছে না। ঋণ আদায়ের ওই প্রক্রিয়াকে মহাজনী ব্যবসা, সুদখোরের ব্যবসার সঙ্গে তুলনা করে মমতা ঘোষণা করেন, “ওই আইন আমরা সংশোধন করব।” মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “সমবায় ব্যাঙ্ক হোক বা বেসরকারি ব্যাঙ্ক ওরা সব স্বশাসিত সংস্থা। সবই ওদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ওদেরও তো বোঝা উচিত!” কৃষকদের ‘আশ্বস্ত’ করে তাঁর ‘বার্তা’ “৩৫ বছরের পাপমোচনে, শাপমোচনে সময় লাগে। আস্তে আস্তে ওদের অনেক কিছু বার হচ্ছে! কিন্তু ন্যায্য ঘটনার ন্যায্য বিচার করব। আমরা গরিব মানুষের পাশে আছি।” |
গোটা ঘটনার উপলক্ষ তমলুকের একটি সমবায় ব্যাঙ্কের নোটিস। ‘দীর্ঘদিন কিস্তির টাকা পরিশোধ না-করায় ও ঋণের টাকা খেলাপি হওয়ায় সমবায় আইন মোতাবেক বন্ধকি সম্পত্তি প্রকাশ্যে নিলাম বিক্রয়ের বিজ্ঞপ্তি’ এই শীর্ষে ‘তমলুক এগ্রিকালচারাল কো-অপারেটিভ অ্যান্ড রুরাল ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক লিমিটেড’ নামে ওই সমবায় যে পোস্টার সেঁটেছে, তাতে স্থানীয় কুরপাই গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চানন চক্রবর্তীর নাম, ছবি ও তাঁর জমিজমার খুঁটিনাটি লেখা আছে। সমবায়ের কাছে পঞ্চাননবাবুর অনাদায়ীর পরিমাণ ১ লক্ষ ১৮ হাজার ২৬২ টাকা, তা-ও বলা আছে। বিক্রয় আধিকারিক মুনমুন সান্যালের (মজুমদার) আবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘ইচ্ছুক ক্রেতাগণকে উক্ত নিলামে অংশগ্রহণ করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে’। সমবায় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ১৬ মার্চ বেলা ১১টায় ওই নিলাম হবে কুরপাই প্রাথমিক স্কুলের মাঠে। পোস্টারের নিচে ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার প্রণব কুমার ভুঁইয়ার নাম।
এই পোস্টার দেখিয়েই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “এটি আমাদের হাতে এসেছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করছি। এফআইআর করতে বলেছি। আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।” সরকারের কাছে কী ভাবে এই পোস্টার এল? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কৃষকেরাই জানিয়েছেন।” সরকার কিছু জানত না? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কী করে জানবে? ৪-৫ হাজার ব্যাঙ্ক আছে। কোথায় কী হচ্ছে, সব কি জানা সম্ভব?”
মুখ্যমন্ত্রী এ কথা বললেও একাধিক সমবায়-কর্তা ওই পোস্টার প্রকাশের পিছনে ‘অন্যায়’ কিছু দেখছেন না। তাঁদের বক্তব্য, ওই সমবায় কর্তৃপক্ষ আইন মেনেই অনাদায়ী ঋণ আদায়ে নোটিস দিয়েছেন। যে কোনও ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় তা শোধের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয় ঋণগ্রহীতাকে। সেই সময় পেরিয়ে গেলে ‘সতর্ক’ করা হয় তাঁকে এবং আবেদন-নিবেদনে কাজ না-হলে বাধ্য হয়ে ঋণগ্রহীতার বন্ধকি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ঋণদাতা সংস্থা। ওই সমবায়-কর্তাদের অভিমত, কোনও কোনও ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যবস্থা না-নেওয়া হলে ঋণ আদায় কার্যত ‘অসম্ভব’ হয়ে দাঁড়ায় এবং আইনে সেই সুযোগই দেওয়া হয়েছে ঋণদাতা সংস্থাগুলিকে।
একই দাবি তমলুকের ওই সমবায়ের চেয়ারম্যান নিকুঞ্জ মান্নারও। তাঁর বক্তব্য, “সমবায় আইন মেনেই ঋণখেলাপিদের বন্ধক থাকা জমি নিলামের নোটিস দেওয়া হয়েছে। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটি অ্যাক্ট’-এর ১২২ ধারায় এ কথা স্পষ্ট বলা আছে।” পূর্ব মেদিনীপুরের শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লক তৃণমূল সভাপতি তথা কাঁখরদা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নিকুঞ্জবাবু। ব্যাঙ্কের ভাইস চেয়ারম্যান তৃণমূলেরই নন্দীগ্রাম-১ ব্লক সভাপতি তথা হরিপুর পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান মেঘনাদ পাল। বস্তুত, ২০১০ থেকেই তমলুকের এই সমবায় ব্যাঙ্কটি তৃণমূল নিয়ন্ত্রিত। দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ দিন মহাকরণে দাঁড়িয়ে ব্যাঙ্কের নিলাম-সংক্রান্ত নোটিসের পোস্টার দেখিয়ে যে ভাবে ‘ব্যবস্থা নেওয়া’র কথা বলেছেন, তাতে ‘বিস্মিত’ নিকুঞ্জবাবু, মেঘনাদবাবুরা।
নিকুঞ্জবাবুর বক্তব্য, “নেত্রীকে নিশ্চয়ই কেউ ভুল বুঝিয়েছেন। ব্যাঙ্ক যে পদক্ষেপ করেছে, তা আইন মেনেই।” তিনি জানান, আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে শুধু চলতি আর্থিক বছরের কিস্তি বাবদই ৮০ কোটি টাকা জমা দিতে হবে সেন্ট্রাল ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কে। ওই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়েই জমি বন্ধক রাখা কৃষকদের ঋণ দেওয়া হয়। বহু বছর ধরে অনেকে ঋণ পরিশোধ করেননি। ফলে, ব্যাঙ্ক এখন চূড়ান্ত আর্থিক সঙ্কটের শিকার। সুদের উপরে ২০% ছাড় দিয়েও ঋণ শোধ করানো যাচ্ছে না। নিকুঞ্জবাবুর দাবি, “নিলাম নোটিসের পর অনেকে ঋণ শোধে আগ্রহী হয়েছে। কেউ কেউ ঋণ মিটিয়েও দিয়েছেন।” |