লক্ষ্মীই এখন বঙ্গ ক্রিকেটের রতন
বে আধ ঘণ্টা হল মুম্বই-নিধন পর্ব শেষ হয়েছে। বিজয় হাজারে ট্রফি এই প্রথম সৌরভের বাংলার। ট্রফি নিয়ে ছবি তোলা সারা। নায়করা একে একে টিম বাসে উঠছেন। পড়ন্ত বিকেলে কোটলায় দিল্লির ক্রিকেটলিখিয়েদের মধ্যে আলোচনা চালু, কী হতে পারে ম্যাচ রিপোর্টের হেডিং?
ফাইনালের নায়ক তো অবধারিত থাকবেনই শিরোনামে। কিন্তু হাওড়ার ঘুসুড়ির যুবককে নিয়ে চটজলদি মাথায় আসা শব্দবন্ধগুলো তো সবই বহু ব্যবহারে মরচে ধরা। সেই তো ঘুরে ফিরে ‘লক্ষ্মীর কৃপায়’, কিংবা ‘লক্ষ্মীর ঝাঁপি’, বা ‘বাংলার লক্ষ্মীলাভ’ ধরনের কিছু। মুম্বইয়ের এক ক্রিকেটলিখিয়ে তখনই আলতো ভাসিয়ে দিলেন মন্তব্য, “শুক্ল ছেলেটা একাই ম্যাচ নিয়ে চলে গেল। এই বেঙ্গল সাইডে কিন্তু ও-ই ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন!’ আরে, ‘জুয়েল’? মানে ‘রতন’? বিশেষণ-উপমা-অনুপ্রাস খোঁজার দরকারই তো নেই। এটাই তো এক কথায় ম্যাচের নির্যাস। ‘লক্ষ্মী’ যখন ‘রতন’!
এবং ‘লক্ষ্মী’ যে দিন ‘রতন’, বাংলা বাঘের মতো! সৌরভের শাণিত ক্যাপ্টেন্সি বা ঝকঝকে ৩৮, বরফশীতল মস্তিষ্ক নিয়ে চাপের মুখে করে যাওয়া অনুষ্টুপের অপরাজিত হাফসেঞ্চুরি, ফাইনালে রান না পেলেও টানা ছয় ইনিংসে ঋদ্ধিমানের হাফ সেঞ্চুরি ইতিহাসের অলিন্দে ঢুকে পড়া জয়ে অবদান অন্যদেরও থাকল। তবে আজকের ‘চক দে বেঙ্গল’-এর চিত্রনাট্যে হিরো লক্ষ্মীরতন শুক্ল-ই। মোক্ষম সময়ে ৩৮ রানে চার উইকেটের বাঁধিয়ে রাখার মতো স্পেল আর ব্যাটে স্ট্রোকের উড়নতুবড়ি ছুটিয়ে ৯০ বলে ১০৬ নট আউট। বাংলা যখন নিশ্চিত জয়ের সরণিতে, জাতীয় নির্বাচক নরেন্দ্র হিরওয়ানি কোটলার বাউন্ডারি লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে অস্ফুটে বললেন, “একা, স্রেফ একা মুম্বইকে উড়িয়ে দিল। বহুদিন মনে থাকবে। এক কথায় অবিশ্বাস্য ব্যাটিং!”
কোটলায় বিজয় হাজারে ট্রফি হাতে ম্যাচের সেরা লক্ষ্মী। ছবি: প্রেম সিংহ।
‘অবিশ্বাস্য’ সম্ভবত সঠিক শব্দ নয়, বলতে হবে ‘অতিমানবিক’। গত কালই হোটেলে তাঁর ঘরে গিয়ে দেখেছি, কী প্রচণ্ড অভিমান ভেতরে জমে রয়েছে। আর কোটলায় দেখলাম, কেন মহম্মদ আলি বলেছিলেন, “নেভার হার্ট আ ইয়ং ম্যানস ইগো!” এক একটা শট তো কোটলায় মাঠের বাইরে পড়ছিল না, পড়ছিল নির্বাচকদের গালে। বাংলা ক্রিকেটের সর্বকালীন ‘হল অফ ফেম’-এ এই পারফরম্যান্স শুধু ঢুকেই পড়ল না, একেবারে সামনের দিকে চিরস্থায়ী আসনও করে নিল।
শুরুটাই ধরা যাক। টস জিতে মুম্বই ব্যাটিং, সকালের কোটলায় বাংলা বোলিংকে নিয়ে সবে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছেন দাড়িওলা ওয়াসিম জাফর। বাঁ-হাতি ইরেস সাক্সেনার এক ওভারে ১৯, সৌরভ সরকারের এক ওভারে ১৪, স্বয়ং সৌরভের এক ওভারে ১১। শুধু আট থেকে দশ নম্বর, তিন ওভারে ৪৪! ঈষৎ বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে সৌরভকে, মাঝে মাঝেই দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছেন। স্কোরবোর্ডে ১২ ওভারে ৮০-০। জল্পনা শুরু হয়েছে, তিনশো হবে না সাড়ে তিনশো। ঠিক এইখানে ১৩ নম্বর ওভারে লক্ষ্মী হয়ে উঠলেন বাংলার ‘রতন’। হাত থেকে বেরোল স্বপ্নের অফকাটার, ছিটকে গেল ৪৮ বলে ৬১ করা জাফরের তেকাঠি। কয়েক ওভার পরে সদ্য অস্ট্রেলিয়া ফেরত অজিঙ্ক রাহানে, তার পরে তিন নম্বরে নামা অনুপ রেবন্ডকর। ৮৩-০ থেকে মুম্বই ১০৮-৩! এই স্পেলে বোলিং হিসেব ৭-১-১৭-৩। ওই শুরু মুম্বইয়ের কেঁপে যাওয়া। আর এখান থেকেই বাংলার ম্যাচ ধরা, এখান থেকেই শুরু ওয়ান ডে ক্রিকেটে ভারতসেরা হওয়ার স্বপ্ন।
কোটলায় কোনও দিন হারেননি, গত কালই কোটলার ড্রেসিংরুমে বসে বলেছিলেন সৌরভ। ‘কেন হারেননি’ খোঁজার চেয়ে এটা বোঝা অনেক বেশি জরুরি, ‘কেন হারলেন না’। প্রথম ওভারেই যখন অজিত আগরকর তুলে নিলেন শুভময়কে, বাংলা ১-১। সেই তো ওপেন করতে নামাই হল। অথচ নিজেকে তিনে রাখতে চেয়েছিলেন। আগরকরকে মিড উইকেটের উপর দিয়ে পুল করে যে বাউন্ডারিটা মারলেন, তা দশ বছর আগের সৌরভকে মনে করায়। অবধারিত প্রশ্ন চলে আসে, কী করে এখনও পারেন। পারেন, কারণ সৌরভ জানতেন, আজ তাঁকেই পারতে হবে। তিনি শুরুতে চলে যাওয়া মানেই ম্যাচ চলে যাবে। পায়ের পেশিতে টান ধরল, তবু ফিজিও ডেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চালিয়ে গেলেন। জানতেন, তিনি অবসর নেওয়া মানেই ‘খাড়ুশ’ মুম্বই আবার ফণা তুলবে। যখন আউট হলেন, রান তাড়া করার মতো একটা ভদ্রস্থ মঞ্চ মিডল অর্ডারের সামনে।
বিজয় হাজারে ঘরে ওঠার পরে সর্বভারতীয় র্যাডার-এ ফের বাংলার ক্রিকেট। সদ্য অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট খেলে ফিরেছেন ঋদ্ধি, এশিয়া কাপের টিমে মনোজ, দিন্দা। বাংলা ক্রিকেটের সুদিন আসার একটা ইঙ্গিত কোটলায় থাকল। সেটার একটা ইঁট পাতা হল মাত্র। তার উপর মাল্টিস্টোরিড হবে কি না, সময় বলবে। কিন্তু ইঁটটা সেই বাংলা ক্রিকেটের চিরকালীন আইকনের হাত দিয়েই পাতা হল।
টিম ইন্ডিয়া-র সোনার সময়ে তিনিই ছিলেন কান্ডারি। টিম বেঙ্গলের সম্ভাব্য স্বর্ণযুগের পত্তনের দিনেও তিনিই ‘মহারাজ’। লক্ষ্মী আজকের নায়ক। ঋদ্ধি, অনুষ্টুপ, দিন্দারা হয়তো আগামীর। কিন্তু ১২ মার্চের কোটলা আবার জানান দিয়ে গেল, বাংলা ক্রিকেটের চিরকালীন মহানায়ক ওই একজনই।
গাঙ্গুলি!

সংক্ষিপ্ত স্কোর
মুম্বই ২৪৮ (জাফর ৬১, যাদব ৫০, লক্ষ্মী ৪-৩৮, সামি ২-৪১)।
বাংলা ২৫২-৪ (লক্ষ্মী ১০৬ নঃআঃ, অনুষ্টুপ ৫০ নঃআঃ)।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.