পাতার রঙ সবুজ থেকে কালো হয়ে গিয়েছে। মৃত্যু হচ্ছে গবাদি পশু, বড় হচ্ছে না মাছের চারা। ঘরের জানলা দরজার পর্দা থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, কয়লার পুরু আস্তরণ পড়ে রয়েছে সর্বত্র। এমনই দাবি জামুড়িয়ার ইকড়া ও রানিগঞ্জের মঙ্গলপুর শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দাদের। সম্প্রতি ইকড়ার বাসিন্দারা পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনার কাছে গণস্বাক্ষর সম্বলিত একটি দাবিপত্রও পাঠিয়েছেন তাঁরা।
ইকড়ার বাসিন্দা বাবন বাউরিয়া জানান, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এলাকায় দু’টি গরুর মৃত্যু হয়। চিকিৎসকেরা জানান, কালো হয়ে যাওয়া ঘাস খেয়ে পেটে অতিরিক্ত কার্বন জমে যাওয়ার জন্যই এমন ঘটনা। শুধু গবাদি পশু নয়, দু’বছরের শিশুও রেহাই পাচ্ছে না এই দূষিত বাতাস থেকে। সর্দি জাতীয় অসুখ সারতে সময় লেগে যাচ্ছে অনেক। বুধন বাউরি, গুণধর বাউরিরা বলেন, “দু’বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর সর্দি সারতে অনেক সময় লাগছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এলাকার দূষণই এর কারণ।” গ্রামের বাসিন্দারা জানান, গ্রামের পাশেই সিঙ্গারন নদীর পাশে দু’টি শ্মশান রয়েছে। কিন্তু নদীর জল ব্যবহার করতে পারেন না কেউ। শবদাহের পরে কারখানার ট্যাঙ্কারের জল বা চাপা কলে স্নান করে বাড়ি যেতে বাধ্য হন তাঁরা। |
স্থানীয় বাসিন্দা সুশীল চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বিদ্যালয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র-সহ লোকালয়ের অদূরে এ ধরনের কারখানা থাকা নিয়মবিরুদ্ধ। ২০০৩ সালে কারখানা নির্মাণের আগেই তা লোকালয় থেকে দূরে করার আবেদন জানানো হয়েছিল। তৎকালীন সাংসদ বিকাশ চৌধুরি ও পুরপ্রধান তাপস কবির সঙ্গে বৈঠকও করা হয়েছিল। বৈঠকে তাঁরা এ ব্যাপারে সহমত হলেও পরে গ্রাম থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বেই কারখানা নির্মাণ হল।” তিনি জানান, একে একে ১৪টি কারখানা তৈরি হয়েছে। প্রতিকার চেয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে চিঠি দেন তাঁরা। তার পরে প্রশাসনের আধিকারিকেরা এলাকায় আসেন। সুশীলবাবুর অভিযোগ, “পুরোটাই যে লোক দেখানো, তা পরে বুঝলাম।”
এলাকার বাসিন্দারা জানান, গত ১৬ নভেম্বর তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ নিয়ে চিঠি পাঠান। দূষণের পাশাপাশি জলসঙ্কটের কথাও জানান তাঁরা। অভিযোগ, কারখানাগুলি গভীর নলকূপ বসিয়ে জল তোলায় ভূগর্ভস্থ জলের অভাব দেখা দেয়। গ্রীষ্মে নাজেহাল হতে হয় তাঁদের। সুশীলবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিলেও কোনও সুরাহা হয়নি।” এর পরে ৩ ডিসেম্বর তাঁরা কারখানা চত্বরে বিক্ষোভ দেখান। কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা বলেন। কিন্তু সমস্যার সুরাহা হয়নি। সুশীলবাবু জানান, এর পরেই জেলাশাসকের কাছে পুনর্বাসনের দাবিতে চিঠি পাঠিয়েছেন তাঁরা। ইকড়ার বাসিন্দাদের ক্ষোভ, বারবার প্রতিবাদ সত্ত্বেও প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই। জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা বলেন, “ওই চিঠি এখনও দেখিনি। মহকুমা প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো উচিত বাসিন্দাদের।”
একই অবস্থা রানিগঞ্জের মঙ্গলপুর শিল্পাঞ্চলে। সাতটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার জন্য ওই এলাকা সংলগ্ন বক্তারনগর, পলাশবন, ধান্ডাডিহির মতো ১০টি গ্রামের বাসিন্দারা নাজেহাল বলে জানিয়েছেন। প্রায় এক দশক আগে বক্তারনগরে সমবায়ের ভিত্তিতে মাছচাষ কর্মসূচির সূচনা হয়েছিল। কিন্তু পরের বছর থেকে জলে কার্যত মাছের চারাই ফেলতে পারেননি সমবায়ের সদস্যেরা। দশ সদস্যের ওই সমবায়ের প্রত্যেকেরই অভিযোগ, দূষণের কারণে মাছ বড় হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা লুইচাঁদ সূত্রধর জানান, দূষণের প্রতিবাদে কারখানা গেটে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য বছর সাতেক আগে তাঁদের গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। মাসখানেক আগে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আসানসোলের আধিকারিক অঞ্জন ফৌজদার গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সমীক্ষা করেন। এলাকার বাসিন্দা তথা কংগ্রেস নেতা সুকুমার খানের অভিযোগ, ‘‘ওই আধিকারিক ঘুরে গেলেন। কিন্তু ফল কিছু হল না। দূষণ নিরোধক যন্ত্র না চালিয়ে, বিধি না মেনেই কারখানা চলছে।”
আসানসোলের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফে জানানো হয়, সমীক্ষা করা হয়েছে। সমস্ত রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। |