উপর্যুপরি দুর্নীতির ঘটনা ও শতেক ঝঞ্ঝাটের পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসের সঙ্কট ছিলই। উত্তরপ্রদেশে ভোট বিপর্যয়ের পর তা যখন আরও ঘনীভূত, এবং মধ্যমেয়াদে বিপন্ন ইউপিএ, তখন বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলের বক্তৃতার মাধ্যমে আজ একটি ভবিষ্যৎ পথনির্দেশ তুলে ধরতে চাইল মনমোহন সিংহের সরকার। লোকসভা ভোটের আগে ফের আস্থা, বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে যে পথনির্দেশের মূল সুর হয়ে উঠল জনমোহিনী নীতি এবং সামাজিক সুরক্ষা। আর্থিক সংস্কারের বিষয়ে বলা হল, সেগুলি ভবিষ্যতে হবে।
বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাই রচনা করে। ফলে রাষ্ট্রপতির এ বারের বক্তৃতার বিষয়বস্তু এক প্রকার প্রত্যাশিতই ছিল। শাসক ও বিরোধী দলের নেতারা মনে করছিলেন, যে হেতু সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেস-বিরোধিতার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তাই সরকারের পক্ষে এখন সাহসী হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। কারণ বিপুল জনমতই সংস্কার কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়। আর বিশ্বাসযোগ্যতায় ঘাটতি হলে জনমোহিনী নীতির আশ্রয় নিতে হয়। তা ছাড়া, শরিক ও সমর্থকরাও এখন চেপে ধরেছে কংগ্রেসকে।
সেই সম্ভাবনাকে সত্যি প্রমাণ করে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় আজ ‘আম আদমি-র’ সুরাহা ও সুরক্ষার বিষয়গুলিই প্রাধান্য পেয়েছে। অধিবেশন শুরুর আগে প্রধানমন্ত্রী যেমন জানিয়েছেন যে তাঁর সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। অস্থিরতার আশঙ্কা নেই। তেমনই রাষ্ট্রপতি তাঁর বক্তৃতায় জানিয়েছেন কী ভাবে ইউপিএ সরকার, গরিব, পিছিয়ে পড়া, তফসিলি জাতি ও উপজাতি, সংখ্যালঘু, স্কুল শিক্ষক, প্রতিবন্ধী, মা ও শিশু-সহ সকলের কল্যাণের জন্য প্রকল্প রূপায়ণ করছে ও ভবিষ্যতে করার অঙ্গীকার করছে।
তবে উপেক্ষিত থেকে গেল পণ্য পরিষেবা কর, প্রত্যক্ষ কর বিধি, পেনশন ও বিমা বিল, খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের মতো সংস্কারের বিষয়গুলি। এই সব প্রকল্প কত দিনের মধ্যে রূপায়িত হবে তার উল্লেখ বক্তৃতায় নেই। একই ভাবে জমি অধিগ্রহণ বিল পাশ করার সদিচ্ছার কথা বলা হলেও তার কোনও সুনির্দিষ্ট সময়সীমা জানানো হয়নি। এই নীরবতা সরকারের দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বলেই অনেকের মত।
সংসদের যৌথ অধিবেশনে তাঁর বক্তৃতার শুরুতেই রাষ্ট্রপতি আজ গোটা বিশ্বের আর্থিক সঙ্কটের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে এ-ও ইঙ্গিত করেন যে, রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনৈতিক অস্থিরতাকে বাড়াতে পারে। তাই সংসদ চালাতে সকলের সহযোগিতা প্রার্থনা করেন তিনি।
আর তার পরেই দুর্নীতি দমনের বিষয়টি উত্থাপন করেন রাষ্ট্রপতি। সবিস্তার জানান, দুর্নীতি দমন করে স্বচ্ছ প্রশাসন কায়েম করতে কতটা সচেষ্ট কেন্দ্রীয় সরকার। রাজনৈতিক নেতাদের অনেকের মতে, রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় যে ভাবে দুর্নীতি দমনের কথা রয়েছে তা দেখে মনে হচ্ছে, কংগ্রেসের মধ্যে এ ব্যাপারে এখনও আশঙ্কা রয়েছে। উপর্যুপরি দুর্নীতির ঘটনা পাঁচ রাজ্যের ভোটে তাঁদের ধাক্কা দিয়েছে বলেই মনে করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
তবে রাষ্ট্রপতির ২১ পৃষ্ঠা দীর্ঘ বক্তৃতার বেশির ভাগটাই দখল করে ছিল বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের কথা। যেমন দ্বাদশ যোজনা কালে ৮ কোটি দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করবে সরকার। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি জাতীয় মিশন গঠন করা হবে। অদূর ভবিষ্যতে দেশের সব মানুষকে সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করা হবে। পাশাপাশি দ্বাদশ যোজনাকালের মধ্যে সাত কোটি মানুষের স্বাস্থ্য বিমার ব্যবস্থা করবে সরকার। জীবিকা সুনিশ্চিত করার জন্য জাতীয় জীবিকা মিশনের সম্প্রসারণ ঘটানো হবে। সেই সঙ্গে দেশের প্রতিটি মানুষের খাদ্য সুরক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত করবে কেন্দ্র।
আম-আদমির সামাজিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার জন্য ইতিমধ্যেই কেন্দ্র যে সব পদক্ষেপ করেছে, তা-ও তুলে ধরেন রাষ্ট্রপতি। এর মধ্যে একশো দিনের কাজ, তফসিলি জাতি উপজাতিভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য ভাতা, কৃষিঋণের পরিমাণ বাড়ানো, তাঁতিদের ঋণ মকুব ও কম সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য ২৩৬২ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা অন্যতম।
আজ রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা চলাকালীন বার বার গোলমাল হয়েছে। কখনও সপা সাংসদদের মন্তব্য নিয়ে সরব হয়েছেন বসপা সাংসদরা। কখনও সংখ্যালঘু সংরক্ষণের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে সরব হয়েছেন বিজেপি নেতা হুকুমদেও নারায়ণ সিংহ। আবার কখনও তেলেঙ্গানার দাবিতে কিছু কংগ্রেস সাংসদ ও শ্রীলঙ্কা প্রশ্নে ডিএমকে সাংসদরা সরব হয়েছেন। অতীতে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা চলাকালীন বিক্ষিপ্ত ভাবে এক জন বা দু’জন সাংসদ সরব হয়েছেন ঠিকই। কিন্তু এত বার বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা সাম্প্রতিক কালে হয়নি। এটাও সরকারের দুর্বলতার লক্ষণ হিসেবে দেখছেন অনেকে। বিশেষ করে সরকারের শরিক ও সমর্থকরাই যখন বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। |
মন জয়ের সাত কাহন |
• ৮ কোটি দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে বরাদ্দ ১৩ হাজার কোটি |
• সরকারি ব্যবস্থায় সবার জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা |
• ৭ কোটি লোকের জন্য স্বাস্থ্য বিমা |
• জাতীয় জীবিকা মিশনের সম্প্রসারণ |
• শিক্ষকদের জন্য জাতীয় মিশন |
• তাঁতিদের ঋণ মকুব ও কম সুদে ঋণ |
• তফসিলি ছাত্রছাত্রীদের জন্য ভাতা |
|