দুই সিপিএম নেতা হত্যার ঘটনায় পুলিশের ‘অনিচ্ছাকৃত খুনের’ মামলা দায়ের করা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করে ফের বিতর্কে জড়ালেন রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। প্রত্যাশিত ভাবেই আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বর্ধমান জেলা সিপিএম নেতৃত্ব। তাঁদের অভিযোগ, তদন্তকে ‘প্রভাবিত’ করতেই আইনমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেছেন।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে বর্ধমানের উপকণ্ঠে দেওয়ানদিঘিতে খুন হন প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক প্রদীপ তা এবং দলের জেলা কমিটির সদস্য কমল গায়েন। রবিবার রাতে বর্ধমান স্টেশন থেকে মন্টু ঘোষ ও নবকুমার রায় নামে দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে সিআইডি। এই নিয়ে জোড়া খুনে গ্রেফতার হলেন ৬ জন। ঘটনার পরে নিহত প্রদীপবাবুর ভাই যে ২২ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন, ধৃত মন্টু ও নবকুমার তাঁদের অন্যতম। সিআইডি-র দাবি, জেরার মুখে ধৃত দু’জন তাদের কাছে দাবি করেছেন, ঘটনার দিন প্রদীপবাবু তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বকে গালিগালাজ করছিলেন। সিপিএমের লোকজন তৃণমূলের পতাকাও ছিঁড়ে দেয়। এতেই উত্তেজিত হয়ে তাঁরা এবং আরও কিছু লোকজন লাঠি, বাঁশ নিয়ে প্রদীপবাবু এবং কমলবাবুর উপরে ‘চড়াও’ হন। দু’জন মার খেয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লে তাঁরা পালিয়ে যান। |
সোমবার সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদার বলেন, “প্রদীপবাবু গালিগালাজ করেছিলেন কি না, তা তো এখন আর জানা সম্ভব নয়! তবে সামান্য অছিলায় কী ভাবে তৃণমূলের লোকজন হিংস্র হয়ে আক্রমণ করেছে, তা ধৃতদের বক্তব্যেই পরিষ্কার।” আইনমন্ত্রী তথা জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক মলয় ঘটক অবশ্য ‘গণরোষ’-এর কথাই ফের বলেছেন। তাঁর বক্তব্য, “ধৃতদের কথায় বোঝা যাচ্ছে, সিপিএমের লোকজন এলাকা দখলের চেষ্টা করেছিল। স্থানীয় মানুষ তা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। এই ঘটনায় অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর ঘটানোর মামলা হওয়া উচিত।”
জোড়া খুনের পরেই মহাকরণ ও তৃণমূল ভবন থেকে রাজ্যের চার মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম ও মলয় ঘটক দাবি করেছিলেন, এই খুন ‘জনরোষের’ ফল। সেই রাতেই দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোড়া খুনের পিছনে সিপিএমের ‘দলীয় কোন্দল’ই দায়ী বলে মন্তব্য করেন। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। এ দিন পুলিশের কোন ধারায় মামলা করা উচিত ছিল বলে আইনমন্ত্রী সেই বিতর্কে আরও ইন্ধন জোগালেন বলেই মনে করা হচ্ছে। যা শুনে অমলবাবুর প্রতিক্রিয়া, “হাইকোর্টের তিরস্কারের পরেও কী ভাবে রাজ্যের কিছু মন্ত্রী তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তা এ থেকেই স্পষ্ট। পুলিশ কোন ধারা দেবে, তা আইনমন্ত্রী নিজেই ঠিক করে দিচ্ছেন!”
এ দিন বর্ধমানের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের (সিজেএম) আদালতে হাজির করিয়ে ধৃতদের দশ দিন হেফাজতে চায় সিআইডি। সিজেএম ইয়াসমিন আহমেদ ধৃতদের চার দিন সিআইডি হেফাজতের নির্দেশ দেন। এর আগে জোড়া খুনের পরপরই ঘটনাস্থল থেকে চার তৃণমূল নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছিল জেলা পুলিশ। কিন্তু ধৃতদের নিজেদের হেফাজতে না চাওয়ায় আদালত তাঁদের জেল-হাজতে পাঠায়। ওই ঘটনায় বিতর্ক দেখা দেয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ঘটনার তদন্তভার পেয়ে সিআইডি ওই চার জনকে হেফাজতে নেয়। গত ৭ মার্চ তাঁদের ফের ১৪ দিন জেল-হাজত হয়েছে।
রবিবার সন্ধ্যায় সিআইডি-র ডিআইজি (অপারেশন) কে জয়রামন বর্ধমানে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই রাতেই বর্ধমান স্টেশন থেকে মন্টু ও নবকুমারকে ধরে সিআইডি। ঘটনার তদন্তকারী সিআইডি অফিসার কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার আদালতে জানান, মন্টু ও নবকুমার মালদহগামী ট্রেন ধরার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়ে গিয়ে তাঁদের ধরা হয়। ধৃতদের বাড়ি বর্ধমানের মির্জাপুরে (প্রদীপবাবুর গ্রামের বাড়ি এখানেই)।
মন্টু ও নবকুমার এলাকায় তৃণমূল করেন বলেই স্থানীয় সূত্রের খবর। এ দিন সিজেএম আদালতে তাঁদের হয়ে সওয়ালও করেন তৃণমূলের আইনজীবী সেলের নেতা সদন তা। শুনানির সময়ে দেখা যায়, সরকারি কৌঁসুলিই উপস্থিত নেই। বিচারক তদন্তকারী অফিসার কল্যাণবাবুকেই ধৃতদের হেফাজতে নিতে চাওয়ার স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দেন। সাক্ষীর কাঠগড়ায় কল্যাণবাবু জানান, খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত লাঠি ও বাঁশ উদ্ধারের জন্য ধৃত দু’জনকে তাঁদের হেফাজতে নেওয়া দরকার।
অভিযুক্তদের আইনজীবীরা পরে দাবি করেন, “পুলিশ আগেই লাঠি, বাঁশ উদ্ধার করেছিল। তাই সে সব উদ্ধারের জন্য দু’জনকে হেফাজতে চাওয়া হাস্যকর। ধৃতদের জেরা করে অন্য অভিযুক্তদের ধরার চেষ্টা হবে কি না, সে ব্যাপারেও সিআইডি আদালতকে কিছু জানায়নি।” কে জয়রামন বলেন, “তদন্তের ব্যাপারে জেলা পুলিশের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে। আরও তথ্য পেতে ধৃত দু’জনকে জেরা করা হবে।”
বর্ধমান জেলা জজ আদালতের সরকারি আইনজীবী সুব্রত হাটী বলেন, “এ দিন নূপুর অগ্রবাল নামে এক কৌঁসুলির ওই শুনানিতে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত সমস্যায় তিনি অন্য এক কৌঁসুলিকে দায়িত্ব দেন। শুনেছি, তিনি মামলার শুনানি না করেই সিজেএমের অনুমতি নিয়ে চলে যান। কেন তিনি থাকলেন না, তা খতিয়ে দেখা হবে।” |