উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হইয়াছেন মুলায়ম সিংহ যাদবের পুত্র অখিলেশ সিংহ যাদব। তাঁহার বয়স ৩৮ বৎসর এবং তিনিই রাজ্যের ইতিহাসে এ যাবৎ সর্বকনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী। রাজনীতিতে বৃদ্ধতন্ত্র অনুশীলনের এই দেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে এক বয়ঃকনিষ্ঠ রাজনীতিকের অভিষেক অভিনন্দনযোগ্য। মুলায়ম সিংহের বয়স হইয়াছে, উপরন্তু তিনি অসুস্থও। তথাপি এই বয়সেও রোগজীর্ণ, অশীতিপর রাজনীতিকদের ক্ষমতার গদি আঁকড়াইয়া থাকিতে দেখিতে দেশবাসী অভ্যস্ত। মুলায়ম সেই হিসাবে ব্যতিক্রম। এ কথা বলা যাইতেই পারে যে, দলে অন্য অভিজ্ঞ ও বয়স্ক নেতার অভাব না থাকিলেও নিজ তনয়ের হাতেই রাজদণ্ড অন্তরিত করার পিছনে বংশানুক্রমিক শাসন প্রতিষ্ঠার একটা তাগিদ রহিয়াছে। দলের প্রবীণ রাজনীতিকদের একাংশ যে এমন মনোভাব পোষণ করে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
কিন্তু অখিলেশ সিংহ যাদব বয়সে যুবক হইলেও অভিজ্ঞতায় অর্বাচীন নহেন। তিন-তিন বার তিনি কান্যকুব্জ লোকসভা কেন্দ্র হইতে নির্বাচিত সাংসদ। সাতাশ বছর বয়স হইতেই পরিষদীয় রাজনীতিতে তাঁহার হাতেখড়ি। তিন বছর আগে দলের সভাপতি নিযুক্ত হওয়ার পর হইতে দলীয় কর্মসূচি রূপায়ণ, শাসক দলের রক্তচক্ষু ও বিরোধিতা অগ্রাহ্য করিয়া রাজ্যময় ঘুরিয়া কর্মীদের সংগঠিত করা, নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন, দলীয় প্রচারে দশ হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ পরিক্রমা করা (যাহার একাংশ সাইকেলে চড়িয়া), কর্মী-সমর্থক ও দলীয় কার্যকর্তাদের উজ্জীবিত করিয়া মায়াবতীর বহুজনসমাজ পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত করার গোটা প্রক্রিয়ায় অখিলেশকেই সামনের সারিতে দেখা গিয়াছে। দক্ষ সেনাপতির মতো তিনি দলকে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়াছেন। ডি পি যাদব কিংবা অমরমণি ত্রিপাঠীর মতো প্রভাবশালী, ওজনদার বাহুবলি নেতাদের মনোনয়ন দিতে অস্বীকার করিয়াছেন। নির্বাচনে দলকে এমন চমকপ্রদ সাফল্য আনিয়া দিবার পর ক্ষমতার মুকুট যে তাঁহার শিরেই পরানো হইবে, ইহা অতএব অপ্রত্যাশিত ছিল না। অনেক বিষয়েই তিনি পিতার অনুগামী নহেন। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় হইতে পরিবেশ-প্রযুক্তিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী অখিলেশ তাঁহার পিতার ন্যায় ইংরাজি ভাষা বা কম্পিউটারের বিরোধী নন। বরং দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে উচ্চ-মাধ্যমিক ও কলেজের পড়ুয়াদের ‘ট্যাবলেট’ কম্পিউটার দিবার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করিয়াছেন। নিজে তিনি আই-ফোন, ব্ল্যাক বেরি বা আইপ্যাড-এর মতো অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিন সামগ্রী ব্যবহার করেন। তারুণ্যের সহিত মানানসই তাঁহার এই আধুনিক জীবনচর্যা রাজ্যের পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনিবে, ইহা আশা করা যাইতেই পারে।
তবে সে জন্য সর্বাগ্রে পূর্ববর্তী মুলায়ম সিংহ জমানার দুর্বৃত্তায়নের ভূতটিকে ঘাড় হইতে নামানো দরকার। সেই জমানায় রাজ্য জুড়িয়া যে ‘গুণ্ডারাজ’ কায়েম হইয়াছিল, তাহার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়াই রাজ্যবাসী মায়াবতীকে ক্ষমতায় আনিয়াছিলেন। এ বারও সমাজবাদী দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় দুইশত জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে মামলা ছিল। তাঁহাদের অনেকেই জয়ী। অখিলেশ ভোট সাঙ্গ হওয়ার পরেই কড়া হাতে দুষ্কৃতীদমনের শপথ উচ্চারণ করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু গণনা ও ফলপ্রকাশের সময় ঝাঁসি সহ বিভিন্ন স্থানে দলীয় সমর্থকরা যে গুণ্ডামিতে লিপ্ত হয়, অনেকের কাছেই তাহা মুলায়ম জমানার দুষ্কৃতী-রাজের বিভীষিকাময় স্মৃতি ফিরাইয়া আনিয়াছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিংহ যাদবের কাছে রাজ্যে আইনের শাসন কায়েম ও সমাজজীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা বজায় রাখার বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় কি না, তাহা দেখিবার। উন্নয়নের যে সব প্রতিশ্রুতি ভোটদাতাদের দেওয়া হইয়াছে, সেগুলির পূরণের দিকেও রাজ্যবাসীর নজর থাকিবে। দেখা যাক, অখিলেশ যাদব তাঁহার প্রতিবেশী রাজ্য বিহারের নীতীশ কুমারের মতো উত্তরপ্রদেশকেও অনগ্রসরতা, দুর্নীতি ও দুষ্কৃতায়নের চোরাবালি হইতে টানিয়া তুলিতে পারেন কি না। |