একেই বলে উভয় সঙ্কট।
শপথ অনুষ্ঠানে থাকার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ জানাচ্ছেন পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিংহ বাদল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের রাজনৈতিক দূত মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বার্তা পাঠাচ্ছেন, “দোহাই ম্যাডাম, ১৪ তারিখ চণ্ডীগড়ে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যাবেন না। বাদল-পুত্র সুখবীর গত কালই ঘোষণা করেছেন, অন্তর্বর্তী নির্বাচন অবশ্যম্ভাবী। সংসদের অধিবেশনের আগে এনডিএ-র বিশ্বস্ত শরিক অকালি দলের ফাঁদে আপনি পা দেবেন না।”
মমতা কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের আজও বোঝানোর চেষ্টা করে বলেছেন, “আমার কাছে উনি বিজেপি বা এনডিএ-র মুখ্যমন্ত্রী নন। উনি পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। পঞ্জাব প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য। মনমোহন সিংহ নিজে উন্নয়ন নিয়ে রাজনীতি করেন না। বরং অকালিদের মুখ্যমন্ত্রীকেও সব রকম উন্নয়নের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তা হলে সেখানে গেলে আমার অসুবিধাটা কোথায়?” মমতার এই যুক্তিকে ‘অকাট্য’ বলে স্বীকার করেও কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিজেপি অন্তর্বর্তী নির্বাচনের দাবিতে সংসদে হাঙ্গামা করবে, মমতা কেন ওদের পালে বাতাস দেবেন? মমতার ঘনিষ্ঠ সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়ানও গত রাতে ট্যুইট করে জানিয়ে দেন যে, তিনি শুনেছেন, পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশ দু’টো শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেই মমতা হাজির থাকবেন। তখন থেকেই গোটা দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে মমতার এই যাওয়া নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে যায়। উত্তেজনা এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, সকালে প্রবীণ এক কংগ্রেস নেতা বলেন, “এতো মনে হচ্ছে জ্যোতিবাবু-হেগড়ে-এন টি রামরাওয়ের সময়কার যুক্তফ্রন্টের রাজনীতি আবার নতুন কলেবরে শুরু হয়ে গেল। একেই কি বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?” উৎকণ্ঠা এতটাই ছড়ায় যে, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি এক বিবৃতিতে তৃণমূলের নাম না-করেও মমতার প্রতি ইঙ্গিত করে জানান, ‘লক্ষ্মণরেখা’ অতিক্রম করা অনুচিত। চণ্ডীগড়ে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিলে যে তা অতিক্রম করা হবে, সে কথাও বোঝাতে ছাড়েননি অভিষেক।
এখানেই শেষ নয়। রাজ্যপাল নারায়ণনও সক্রিয় হন। তিনিও বিভিন্ন দূত মারফত বার্তা পাঠান, ১৫ তারিখ যে হেতু বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিন, সে দিন মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় উপস্থিত থাকলে তিনি খুশি হবেন। প্রসঙ্গত, তার আগের দিনই আবার নন্দীগ্রাম দিবস।
শেষ পর্যন্ত এই টানাপোড়েনের মধ্যে মমতা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পঞ্জাবের সফর যদি বাতিল করতে হয়, তা হলে তিনি লখনউও যাবেন না। কেন না, তাঁর কাছে দু’জনেই মুখ্যমন্ত্রী। এক জনের অনুষ্ঠানে যাবেন আর অন্যেরটায় যাবেন না, সেটা কেমন করে হয়? এক প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি নিজে দু’টি শপথগ্রহণেই যেতে আগ্রহী। কিন্তু যেতে পারব কি না বুঝতে পারছি না। কারণ বিধানসভায় রাজ্যপালের বক্তৃতার সময়েও অনুপস্থিত থাকতে চাই না। তবে এই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান নিয়ে আপনারা যে ভাবে এনডিএ-রাজনীতির কথা বলছেন, তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের কথা বলছেন, সেটা আমার কাছে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। আমি দু’জন মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। কোনও রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি না। বাদল এবং অখিলেশ দু’জনকেই দীর্ঘদিন ধরে চিনি। সুতরাং ওখানে গেলেও তার মধ্যে রাজনীতি নেই।” দলীয় সূত্রের খবর, স্থির হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে না গেলেও পঞ্জাবে রচপাল সিংহ এবং কে ডি সিংহকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠাবেন। আর লখনউতে পাঠানো হবে সুলতান সিংহকে।
তৃণমূলের নেতারা অবশ্য বলছেন, এখন পরিস্থিতি যা দাঁড়াল, তাতে না গেলেও মমতার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়ে গেল। প্রথমত, জাতীয় রাজনীতিতে মমতার প্রাসঙ্গিকতা আবার প্রতিষ্ঠিত হল উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের পরে। দ্বিতীয়ত, এনডিএ এবং কংগ্রেস দু’পক্ষের মধ্যে তাঁকে নিয়ে যে দড়ি টানাটানি চলছে, তা অব্যাহত থাকল। যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি কংগ্রেসের উৎকণ্ঠা বাড়ালেন এবং সুকৌশলে দর কষাকষির রাজনীতিতে এগিয়ে থাকলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের যখন দু’বছরেরও বেশি বাকি এবং এক দিকে কংগ্রেস বিপর্যস্ত, অন্য দিকে বিজেপি-ও সেই জায়গা দখল করতে পারছে না, তখন আঞ্চলিক দলগুলি খুব স্বাভাবিক ভাবেই পরিস্থিতি পরীক্ষা করে দেখতে চাইবে। এটা সকলের কাছেই স্পষ্ট। এই রকম একটা অবস্থায় মমতারও এখন তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। মমতা পরিস্থিতি পরীক্ষা করছেন ঠিকই, কিন্তু এখনই দিল্লিতে এসে কোনও শিবিরে যোগ দেওয়াটা তাঁর লক্ষ্য নয়। নিজের প্রাসঙ্গিকতা রক্ষা করে আগামী দিনগুলিতে তিনি কী ভাবে এগোবেন, এখন সেটাই দেখার। আপাতত সব পক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করে এগোনোটাই মমতার রণকৌশল।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও মমতার সঙ্গে মিটমাটের চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। সংসদীয় অধিবেশনের আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হয়ে প্রধানমন্ত্রী বার্তা পাঠিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সচিব গৌতম সান্যাল প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেছেন। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় মমতাকে ফোন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী যে মমতার সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী, সে কথা তিনিও তৃণমূল নেত্রীকে জানিয়েছেন। আরও জানিয়েছেন, এখন যে আর্থিক শৃঙ্খলা আইন হয়েছে, তাতে কোনও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী কোনও একটি রাজ্যকে বিশেষ প্যাকেজ দিতে পারেন না। বিশেষ প্যাকেজ যদি দিতে হয়, তা হলে প্রধানমন্ত্রী স্তরে মমতার সঙ্গে আলোচনা হওয়া দরকার। উল্লেখ্য, সম্প্রতি মমতা যখন মনমোহনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তার এক দিন আগে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে আর্জি জানান, রাজ্যের বকেয়া ঋণের সুদে যেন তিন বছরের জন্য ছাড় দেওয়া হয়। কুড়ানকুলাম নিয়ে জয়ললিতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বোঝাপড়ারও চেষ্টা চলছে। জয়ললিতা তাঁর ‘উইশলিস্ট’ পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। জয়ললিতার মতোই মমতার সঙ্গে সম্পর্কের জটটা ছাড়াতেও কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষ ভাবে আগ্রহী। এমনিতেই রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী নির্বাচনের কথা বলায় যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছিল। সেটা বাড়তে দেওয়া মমতারও লক্ষ্য নয়। সে জন্যই এক কদম এগিয়েও তিনি দু’কদম পিছিয়ে এলেন বলেই ধারণা। একে বলা যেতে পারে তৃণমূল নেত্রীর একটি রাজনৈতিক কৌশল।
সংসদের সেন্ট্রাল হলে এক প্রবীণ সাংসদের মক্তব্য, মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্বের মোটে ৯ মাস হয়েছে। রাজ্যস্তরে তাই তিনি এখনও নবীনা। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে যে তিনি নবীন নয়, সেটা বুঝতে ভুল হচ্ছে না! |