মাধ্যমিকের ছুটি স্কুলে, সন্ধ্যায় ‘ক্লাস’ নিচ্ছেন শিক্ষকেরা
রুমা খাতুন আর সন্ধ্যা হলেই মা’কে সাহায্য করতে উনুনের পাশে বসে না। সাজাহান শেখের বাড়িতে সন্ধ্যায় আশপাশের বাড়ির কিশোর-কিশোরীরা আর টেলিভিশন দেখতে আসে না। হোসেন শেখ খেত থেকে ফিরে বাড়িতে ছেলেকে দেখতে পান না।
তাঁরা জানেন, একটু দূরে ভৈরবের ধার ঘেঁসে নসিপুর হাইমাদ্রাসায় গেলেই খোঁজ মিলবে সকলেরই। স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। তারপরে ওই ক্লাস ঘরেই শুরু হচ্ছে আবার পঠনপাঠন। চলছে সেই রাত পর্যন্ত। মাদ্রাসার শিক্ষক মাসুদ আলম বলেন, “মাধ্যমিকের আসন পড়েছে স্কুলে। তাই ক্লাস বন্ধ। কিন্তু এত দিন ধরে ছুটি চলতে থাকলে ছাত্রছাত্রীরা খুবই পিছিয়ে পড়বে। তাই আমরা ঠিক করেছি, বিকেলে ক্লাস নেব।” এই মাদ্রাসায় এখন তাই ‘ক্লাস’ শুরু হচ্ছে বিকেল থেকে। চলছে সেই রাত পর্যন্ত। নবম শ্রেণির রুমা বলে, “আমাদের স্কুলটাই যেন বিকেলে হয়ে গিয়েছে।”
পিছিয়ে পড়া মুর্শিদাবাদ জেলার আরও পিছিয়ে পড়া ডোমকল মহকুমার ইসলামপুরের এই নসিপুর গ্রামে এই মাদ্রাসার শিক্ষকদের বাড়ি মালদহ, বাঁকুড়া, বর্ধমান বা বীরভূমে। এখানে শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে এসে এই গ্রামেই তাঁরা বাড়ি ভাড়া করে থাকেন। বাঁকুড়ার আলি হোসেন খান বলেন, “সন্ধ্যাবেলাগুলো এমনিতেই কাটে আড্ডা দিয়ে বা টিভি দেখে। সেই সময়টাই আমরা কাজে লাগাতে চাইছি।
সন্ধ্যায় বসেছে ‘ক্লাস’। ছবি: বিশ্বজিৎ রাউৎ
মাদ্রাসার বাড়িতেই বিকেলে পড়ানো শুরু করতে দেখলাম গ্রামের মানুষেরও উৎসাহ কম নয়।” ইসলামপুরের মৌলবী মহম্মদ আনসার আলির কথায়, “ওই শিক্ষকেরা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছেন। ওই মাদ্রাসার অনেক ছাত্রই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। স্কুল ছুটি থাকলে, বাড়িতে তাদের পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। শিক্ষকেরাই যে অবসর সময়ে পড়ানো শুরু করে সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তাতে গ্রামের মানুষ তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।”
প্রধানত এই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের জন্যই এই শিক্ষকেরা পড়ানোর ধরনেও অনেক আধুনিকতা এনেছেন। কম্পিউটারও ব্যবহার করেন তাঁরা। দিন প্রতি এক হাজার টাকায় একটি প্রজেক্টর ভাড়া করা হয়েছে। পর্দায় তা থেকে নানা গাছপালা পশু-পাখির ছবি দেখানো হচ্ছে। নবম শ্রেণির জেসমিনা খাতুন বলে, “টিভিতে আগে পেঙ্গুইন দেখেছি। কিন্তু ওদের সম্বন্ধে এত কথা জানতাম না। অ্যান্টার্কটিকা সম্বন্ধেও অনেক কথা জানলাম। আফ্রিকার জঙ্গলের গল্পও শুনলাম।” শিক্ষকেরা সহজ ইংরেজিতেই ছাত্রছাত্রীদের সব বোঝানোর চেষ্টা করেন। কেন? শিক্ষিকা মৌমিতা আলম বলেন, “পশুপাখির ছবি দেখিয়ে তাদের গল্প বলতে বলতে সহজে ইংরেজিটা শিখিয়ে দেওয়া যায়। তাতে ইংরেজি শব্দভাণ্ডার যেমন বাড়ে, ভয় কেটে যায়। তেমন ইংরেজিতে কথা বলাতেও সাচ্ছন্দ্য তৈরি হয়।” মৌলবী আনসার আলির কথায়, “মাদ্রাসাতে ইংরেজি চর্চার প্রয়োজন রয়েছে, সেটা এই শিক্ষকেরা বুঝেছেন। গ্রামের লোকেরাও বুঝেছেন।”
পুরনো বর্ধিষ্ণু এই গ্রামের শিক্ষার হার কিন্তু মাত্রই ৪০ শতাংশ। অধিকাংশ মানুষের জীবিকা কৃষি। কেউ কেউ রেশম শিল্পে জড়িত। গ্রামের বাসিন্দা সাজাহান বলেন, “আমার বাড়িতে সন্ধ্যে হলেই টিভি দেখতে ভিড় করত কচিকাচারা। সিনেমা কিংবা খেলা দেখত। তাতে ওদের শুধু সময় নষ্ট হত না, ভবিষ্যৎও নষ্ট হত। কিন্তু কিছু বললে প্রতিবেশীরা মনে করতে পারত। তাই চুপচাপ সহ্য করতাম। এখন ওই শিক্ষকেরা গ্রামের পরিবেশটাই পাল্টে দিয়েছেন।”
সকলেই চাইছেন, সন্ধাগুলো তাঁদের ছেলেমেয়েদের যেন পড়াশোনাতেই কাটে। তাই সন্ধ্যাবেলার এই ‘স্কুলে’ উপস্থিতির হার খুবই ভাল। শিক্ষকেরা নিজেদের টাকাতেই সন্ধে বেলায় পড়ুয়াদের সিঙ্গারা, মিষ্টি পর্যন্ত কিনে দিচ্ছেন। রাজ্য মাদ্রাসা বোর্ডের সম্পাদক সৈয়দ নুরুস সালাম বললেন, “ওই শিক্ষকেরা একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ করছেন। আমরা দেখছি, যাতে ওঁদের একটি প্রোজেক্টর কিনে দেওয়া যায়।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.