দলে গোষ্ঠী-লড়াইয়ের কথা সরাসরি দলের কর্মীদের সামনেই স্বীকার করে নিলেন তৃণমূলের সাংসদ শতাব্দী রায়। তাঁর মতে, সিপিএম বা অন্য দলের চেয়ে তৃণমূলের নিজের লোকজনই দলের বেশি ক্ষতি করছেন! সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় তৃণমূলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব নিয়মিত প্রকাশ্যে আসছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে শতাব্দীর মন্তব্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছে তৃণমূলেরই একাংশ।
শনিবার বীরভূমের সিউড়িতে তৃণমূলের ‘সিউড়ি শহর রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলন’-এ শতাব্দী বলেন, “রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া সকলেই বদলে গিয়েছে। আমরা যারা দলের সঙ্গে ছিলাম, যারা নতুন ঢুকেছে সকলেই বদলে গিয়েছে। সিপিএম বা অন্য দল তৃণমূলের যত না ক্ষতি করছে, তার থেকে ঢের বেশি ক্ষতি আমরা নিজেরাই করছি!”
ঘটনাচক্রে, একই দিনে এমন ‘স্বীকারোক্তি’ পাওয়া গিয়েছে রাজ্যের অন্যত্রও। রাজ্যের ‘শিল্পমুখ’ হলদিয়ায় শাসকদলের একাধিক গোষ্ঠীর কোন্দলে বিভিন্ন কারখানায় যে ‘বিরূপ প্রভাব’ পড়ছে, তা ‘প্রকারান্তরে’ স্বীকার করে নিয়েছেন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য নেতৃত্ব। এ দিন হলদিয়ায় এক আলোচনাসভায় যোগ দেন শ্রমমন্ত্রী তথা তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য চেয়ারম্যান পূর্ণেন্দু বসু এবং সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শ্রমমন্ত্রী বলেন, “কোথাও কোথাও এই সমস্যা (একাধিক গোষ্ঠী ও তাদের দ্বন্দ্ব) রয়েছে। তারা মিলে গেলে ভাল হয়।” তবে তাঁর দাবি, “দল থাকলেই গোষ্ঠী থাকবে। ক্লাবেও গোষ্ঠী থাকে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অঙ্গই হয়ে গিয়েছে এই গোষ্ঠীতন্ত্র।” আর দোলার বক্তব্য, “গণমাধ্যম যে মাত্রায় গোষ্ঠী-সংঘর্ষের প্রচার করছে, সেটা ঠিক ছবি নয়। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে।” শুক্রবার সিউড়িতেই তৃণমূলের একটি কর্মী সম্মেলন হয়। সেখানে ছিলেন প্রাক্তন পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামীরা। কিন্তু শতাব্দী, দলের জেলা চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, সিউড়ির তৃণমূল বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষ ছিলেন না। এ দিনের সভায় আবার গরহাজির ছিলেন অনুব্রত-চন্দ্রনাথের অনুগামীরা। তাঁকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি দাবি করে অনুব্রত বলেন, “যা হওয়ার, কালকেই হয়ে গিয়েছে। শুনলাম, এ দিন ছেলেমানুষি গোছের কিছু একটা হয়েছে!” যে প্রতিক্রিয়া শতাব্দীর বক্তব্যকেই ‘ঠিক’ প্রমাণিত করে। |
বীরভূমে গত লোকসভা ভোটের আগে থেকেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তীব্র। শতাব্দীর নির্বাচনী প্রচারের সময়ে রাজনগরের এক জনসভায় তাঁর সামনেই দুই নেতা বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তৃণমূল সূত্রের খবর, শতাব্দী তখনই ঘটনাটি মমতাকে বলেছিলেন। তার পর আশিসবাবুকেই সর্বত্র প্রচারে নিয়ে যান শতাব্দী। অনুব্রতর সঙ্গে তাঁদের ‘দূরত্ব’ বাড়ে। পরে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ-দেওয়া স্বপনবাবুও সাংসদের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবেই পরিচিত হন।
এ দিনের কর্মী সম্মেলনে সরাসরি চন্দ্রনাথের নাম না-করলেও স্বপনবাবু বলেন, “জেলা সভাপতির অনুগামী এক নেতাকে প্রথমে গ্রামোন্নয়ন দফতর দেওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। তিনি পঞ্চায়েতের আইনকানুন কিছুই বোঝেন না। বহু রাস্তা প্রকল্পের টাকা ফেরত চলে গিয়েছে। দিদি প্রথমে ওই দফতরে ঠিক মন্ত্রী নির্বাচন করেননি। ভুল বুঝতে পেরে ওই দফতর কেড়ে নিয়েছেন।” চন্দ্রনাথবাবু বলেন, “নিজে না-জেনে মন্তব্য করা ঠিক নয়। আমি দিদির প্রতি আস্থাশীল। উনি যা ভাল ভেবেছেন করেছেন।”
এ দিনই মঙ্গলকোটে তৃণমূলের ‘পঞ্চায়েতি রাজ’ সম্মেলন ছিল। তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠীর তরফে পোস্টার দিয়ে তারাই সম্মেলন করছে বলে দাবি করা হয়। দু’টি পৃথক মঞ্চও বাঁধা হয়। স্থানীয় শ্যামবাজারে মঞ্চ বাঁধেন অনুব্রত-অনুগামীরা। খুদরুন মোড়ে বাঁধা হয় অপর মঞ্চ। তবে শেষমেশ অনুব্রতদের মঞ্চেই সম্মেলন হয়। চন্দ্রনাথ সেখানে ছিলেন। ছিলেন অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মঙ্গলকোটের নেতা অপূর্ব চৌধুরী। অপর গোষ্ঠীর কেউ আসেননি।
স্থানীয় ‘বিক্ষুব্ধ’ গোষ্ঠীর নেতা প্রণব মণ্ডলের দাবি, “আমি দলের মঙ্গলকোট ব্লক সভাপতি। অথচ ওঁরা আমাদের সম্মান দিচ্ছেন না। তাই কর্মীদের অনুরোধে পাল্টা সম্মেলনের ডাক দিয়েছিলাম।” অপূর্ববাবুর অবশ্য দাবি, “দলের সমস্ত স্তরের অনুমতি নিয়ে সম্মেলনের কথা ঘোষণা করেছিলাম। তা সত্ত্বেও ওরা পাল্টা সম্মেলনের পোস্টার দেয়।” আর অনুব্রত বলেন, “তৃণমূলে প্রণব মণ্ডল কেউ নয়। ওদের কথার গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই।”
তৃণমূল সূত্রের খবর, শুক্রবার রাতে প্রদেশ তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক তথা বর্ধমান জেলার পর্যবেক্ষক অলোক দাস দুই গোষ্ঠীর নেতার বাড়িতে গিয়ে কথা বলায় ‘মুখরক্ষা’ হয়। অলোকবাবু বলে, “বিকাশ চৌধুরীকে পৃথক সম্মেলন করা থেকে বিরত করি।” আইনমন্ত্রী মলয়বাবুও বলেন, “মঙ্গলকোটে দু’টি সম্মেলন হচ্ছে খবর পেয়ে উদ্যোগী হয়ে একটি সম্মেলন বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিই।”
তৃণমূলের কর্মী সম্মেলন ঘিরে এ দিন উত্তেজনা ছড়ায় রানিগঞ্জের বার্নস ক্লাবেও। স্থানীয় বিধায়ক সোহরাব আলি, জেলা সভাপতি (বর্ধমান শিল্পাঞ্চল) অপূর্ব মুখোপাধ্যায়, জেলা সাধারণ সম্পাদক ভি শিবদাসন ও জেলা পর্যবেক্ষক অলোক দাস সেখানে ছিলেন। কিন্তু দুপুরে একটি মিছিল গেলে ক্লাবের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মিছিল থেকে সম্মেলনের উদ্দেশে কটূক্তি করা হয়। উত্তরবঙ্গে রাজ্যের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং বিধায়ক তাপস রায়ের সামনেই কর্মীদের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন কারামন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী এবং কুমারগঞ্জের বিধায়ক মাহমুদা বেগম। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে দলের জেলা সম্মেলনে সমালোচনার মুখে সভামঞ্চেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বিধায়ক মাহমুদা। কুমারগঞ্জের বিধায়কের বিরুদ্ধে ‘সিপিএম ঘনিষ্ঠতা’র অভিযোগ তোলা হয়েছে। কারামন্ত্রী বেশির ভাগ সময়ে ‘কলকাতায় পড়ে থাকেন’ বলেও অভিযোগ করেন কর্মীরা।
সামগ্রিক এই পরিস্থিতি শতাব্দীর কথাকেই ‘বৈধতা’ দিচ্ছে। এখন দেখার, দলীয় নেতৃত্ব সাংসদের কথায় কতটা ‘গুরুত্ব’ দেন। |