সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এ বার অতি-সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আজ সকাল থেকেই কালীঘাটের বাড়িতে আসছে ফোনের পর ফোন। পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিংহ বাদল ১৪ তারিখে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মমতাকে হাজির থাকার জন্য বারবার অনুরোধ জানাচ্ছেন। বাদলের অফিস থেকে ফোন আসছে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়েও। আবার আনুষ্ঠানিক ভাবে লখনউয়ের তখ্তে বসার দিনটাতে মমতাকে অতিথি হিসেবে চাইছেন অখিলেশ যাদব। উত্তরপ্রদেশের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ আজ চিঠি দিয়ে মমতাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ১৫ তারিখ তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির থাকার জন্য। তাঁর অনুরোধ, “দেশের সর্বকনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দিদি আপনাকে আসতেই হবে।” মমতা ব্যক্তিগত এক সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৩ তারিখে নাগপুর যাচ্ছেন। সেখানেই পঞ্জাব সরকার মমতার জন্য বিশেষ বিমানের আয়োজন করেছে। সেই বিমানে চেপে তিনি চণ্ডীগড় যাবেন। ১৪ তারিখ চণ্ডীগড়ে বাদলের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। সেখানে যোগ দেওয়ার পর আবার পঞ্জাব সরকারই তাঁকে পর দিন লখনউ পৌঁছে দেবে।
এর আগে ভোটের ফল বেরোনোর দিনই মুলায়মকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মমতা। বলেছিলেন, “নেতাজি, আপনে তো কামাল কর দিয়া।” বাদলের ছেলে সুখবীর আর এক কদম এগিয়ে। তিনিই মমতাকে বার্তা দিয়ে জানিয়েছেন, “পঞ্জাব সরকার আপনার জন্য বিশেষ বিমান পাঠাবে। আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে।” রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কারও কারও ধারণা, বাদল এনডিএ-তে বিজেপি-র বিশ্বস্ত শরিক। পুরনো এনডিএ-র শরিকদের তাই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ডাকার মধ্যে অনেকে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন। কারণ, বাদল ডিএমকে-কেও ডেকেছেন। কিন্তু তৃণমূল-সূত্র বলছে, এ ব্যাপারে মমতা খুবই সজাগ ও সতর্ক। মমতা বলেন, “আমি বাদলের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যাচ্ছি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। এর সঙ্গে বিজেপি বা এনডিএ-র কোনও সম্পর্ক নেই। আবার অখিলেশের বয়সও কম। ওঁর সঙ্গেও আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক।”
বাদলের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়ে পাছে এনডিএ-র রাজনীতির সঙ্গে তাঁকে কেউ এক করে দেখে, সে ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক মমতা। সে কারণে তিনি দু’টি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেই যাচ্ছেন। কিন্তু তাতেও উদ্বেগ কাটছে না কংগ্রেসের। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের পরে কংগ্রেস নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, সোমবার থেকে শুরু হতে যাওয়া সংসদের বাজেট অধিবেশনে যথেষ্ট দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে পড়তে হবে সরকারকে। সনিয়া গাঁধী ইতিমধ্যেই তাই শরিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এগোতে বলেছেন দলীয় নেতৃত্বকে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও আসন্ন। সেখানেও শরিকদের সমর্থন ছাড়া কংগ্রেস প্রার্থীর পক্ষে জেতা অসম্ভব। শুধু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনই নয়, রাজ্যসভার নির্বাচনেও এখন মমতাকে দরকার। এই দফায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে দলের এক জন সাংসদকে জেতাতেও তৃণমূলের ৫-৬ জন বিধায়কের সমর্থন প্রয়োজন। ফলে সে ক্ষেত্রেও মমতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সাহায্যের মতো বকেয়া বিষয়গুলি তড়িঘড়ি মেটাতে তৎপর হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। তাঁর সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রণববাবু ফোনে কথা বলেছেন মমতার সঙ্গে। তাঁকে বুঝিয়েছেন, কোনও একটি রাজ্যকে বিশেষ ছাড় দেওয়াটা শুধু অর্থমন্ত্রীর এক্তিয়ারভুক্ত বিষয় নয়। এখানে প্রধানমন্ত্রীরও সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। এরই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সচিব গৌতম স্যান্যাল দিল্লিতে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা টি কে এ নায়ার ও সচিবালয়ের অন্য কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে তিনি আজ দেখা করেন। রাজ্যের মুখ্যসচিব থেকে শুরু করে আর্থিক প্রস্তাবগুচ্ছ, যাবতীয় বিষয় নিয়ে গৌতম কথা বলেছেন বলে জানা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এই পরিস্থিতিতে মমতার সঙ্গে খুব শীঘ্রই বৈঠক করতে চাইছেন। মমতা দিল্লি এলেই এই বৈঠক করতে চান তিনি।
একটা বিষয় এখন স্পষ্ট, মমতাকে নিয়ে জাতীয় স্তরে আর এক দফা দড়ি টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছে। এক দিকে প্রধানমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব, আর অন্য দিকে মুলায়ম থেকে বাদল। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “রাজনীতি সব সময়ই সম্ভাবনার খেলা। মমতাকে নিয়ে এই দড়ি টানাটানির মধ্যে দিয়ে সেই বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে।” তাঁর কথায়, “উত্তরপ্রদেশে ফল প্রকাশের পরে অনেকে অন্তর্বর্তী নির্বাচনের কথা বলছেন। সেটি যদি না-ও হয়, ২০১৪ সালের আগে আঞ্চলিক দলগুলির ফেডারেশনের কথা কিন্তু অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন।”
কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ তথা এই নেতার কথাতেও, এখন অন্তর্বর্তী নির্বাচন হলে লাভ হবে মুলায়ম, জয়ললিতা, নীতীশ ও মমতার।
ওই শীর্ষ নেতাটি বলেন, “কংগ্রেসও এটি ঠেকানোর চেষ্টা করছে। মমতার কাছে ১৯-২০ জন সাংসদ রয়েছে। আঞ্চলিক দল হয়েও তাই তিনি জাতীয় স্তরে ফের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র হয়ে উঠেছেন।”
জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়াটা অবশ্য মমতার কাছে নতুন নয়। তিনি রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছেন মাত্র আট মাস। তুলনায় জাতীয় রাজনীতিতে প্রশাসক হিসেবে বেশি দিন কাজ করেছেন। নরসিংহ রাও জমানায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু। তার পর কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে তৃণমূল গঠন, এনডিএ-র রাজনীতি, কেন্দ্রে একাধিক বার রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্ব সামলানো, সবই করেছেন তিনি।
ইউপিএ-২ যখন শেষ লগ্নে আসতে শুরু করেছে, তখন মমতা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। দিল্লি তাঁকে এখন নবরূপে দেখছে। |