তরাই-ডুয়ার্স নিয়ে অনড় মোর্চা
রাজ্যের ঘাড়ে দায় দিয়ে সায় জিটিএ-তে
গোর্খাল্যান্ড আঞ্চলিক প্রশাসন বা গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) সংক্রান্ত বিলে সই করে দিলেন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল। এর ফলে জিটিএ-র নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করতে আর আইনগত বাধা রইল না। যদিও জিটিএ-র এলাকা অন্তর্ভুক্তি এবং সংরক্ষিত অরণ্যের উপর অধিকার সংক্রান্ত ‘বিতর্কিত’ বিষয় দু’টি নিষ্পত্তির দায়িত্ব রাজ্য সরকারের উপরেই ছেড়ে দিচ্ছে কেন্দ্র।
অর্থাৎ, জিটিএ-র এলাকায় তরাই-ডুয়ার্সের অন্তর্ভুক্তির দাবিকে ঘিরে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ও রাজ্যের মধ্যে যে টানাপোড়েন রয়েছে, তা মেটানোর দায় কৌশলে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের ঘাড়ে রাখল না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, বুধবার সকালেই প্রতিভা পাটিলের স্বাক্ষরিত জিটিএ বিল রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে নর্থ ব্লকে পৌঁছয়। এ বার তা রাজ্যের কাছে পাঠানো হবে। রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন সিলমোহর বসালেই এই বিল রাজ্য-আইনের মর্যাদা পাবে। চুক্তি সইয়ের খবর পেয়ে এ দিন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “হোলির আগে মিষ্টিমুখ!’’
মুখ্যমন্ত্রী এ কথা বললেও বিলের বর্তমান চেহারায় তার বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। কারণ, মোর্চা নেতৃত্ব এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন, তরাই-ডুয়ার্সের এলাকার অন্তর্ভুক্তি ছাড়া জিটিএ-র নির্বাচন হবে না। বস্তুত, এই বিল নিয়ে পাহাড় জুড়ে মোর্চা সমর্থকদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে জিটিএ আইন অনুসারে এই স্বশাসিত সংস্থার দায়িত্বে থাকবেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। মনোনীত জিটিএ-র কোনও জায়গাই নেই। কিন্তু তরাই ও ডুয়ার্সের কোন কোন এলাকা জিটিএ-র অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, তা এখনও পরিষ্কার হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের মতোই রাজ্যের কোর্টে বল ঠেলেছে মোর্চাও। এ দিন মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি বলেন, “জিটিএ বিলে রাষ্ট্রপতি সই করায় আমরা খুশি। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কথা রেখেছে। কিন্তু জিটিএ কী ভাবে বাস্তবায়িত হবে, বুঝতে পারছি না। জিটিএ-র এলাকাই তো ঠিক হয়নি! তাহলে নির্বাচন হবে কী করে? রাজ্য সরকারকেই কোনও একটা রাস্তা বার করতে হবে। তার আগে নির্বাচনের প্রশ্ন নেই।” জিটিএ নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে গেল বলে মনে করছেন সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টচার্যও। তিনি বলেন, “পাহাড়ের তিন মহকুমা নিয়েই তা গঠন করা হোক। কিন্তু সীমানা নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা রয়েছে। এখন সবই রাজ্য সরকার ও মোর্চার বিষয়।” উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য বলেছেন, “পুরোটাই মুখ্যমন্ত্রী দেখছেন। যা বলার উনিই বলবেন।”
বিষয়টি নিয়ে মোর্চার সঙ্গে যাদের সংঘাত, সেই আদিবাসী বিকাশ পরিষদের হুঁশিয়ারি, তরাই-ডুয়ার্স জিটিএ-তে ঢুকলে তারা ‘চুপ করে বসে থাকবে না’। রাজ্য সভাপতি বীরসা তিরকি এ দিন বলেন, “একে তো মোর্চার অধিকাংশ সমর্থকই বাইরে থেকে এসেছেন। তার পরেও জিটিএতে যেটুকু সুবিধা দেওয়া হয়েছে পেয়েছে সেটাই ওঁদের পাওয়া উচিত ছিল না। এর পরে তরাই ও ডুয়ার্স অন্তর্ভুক্তি নিয়ে চিন্তাভাবনা করাটাই অন্যায়।”
গত বছর ১৯ জুলাই শিলিগুড়ি লাগোয়া পিনটেল ভিলেজে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে জিটিএ চুক্তি হয়। প্রথম থেকেই পাহাড়ের তিন মহকুমার পাশাপাশি তরাই ও ডুয়ার্সের মোট ৩৯৯টি মৌজাকে জিটিএ-র অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলেছেন বিমল গুরুঙ্গ-রোশন গিরিরা। বিষয়টি ঠিক করতে জিটিএ চুক্তির পরেই রাজ্য সরকার বিচারপতি শ্যামল সেনের নেতৃত্বে ‘হাই পাওয়ার’ কমিটিও গড়ে। বর্তমানে এলাকার নির্ধারণ পুরোটাই ওই কমিটির বিবেচ্য বিষয়।
এই অবস্থায় বিধানসভায় জিটিএ বিল পাশ হয়ে তা কেন্দ্রের কাছে পাঠানো হলেও সীমানা নির্ধারণ বিতর্কের নিষ্পত্তি আজও হয়নি। চিদম্বরম আগেই জানিয়েছিলেন, সুবাস ঘিসিংয়ের সময়ের দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল বা ডিজিএইচসি-র আওতায় যে এলাকা ছিল, রাজ্যের পাঠানো জিটিএ বিলে সেই একই এলাকা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অতিরিক্ত এলাকা যোগ হবে কি না, তা কমিটির সুপারিশ মেনে রাজ্যকেই প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তরাই-ডুয়ার্সের পাশাপাশিই সংরক্ষিত অরণ্যের অধিকার চেয়েও বারবার কেন্দ্রের কাছে দরবার করেছেন মোর্চা নেতারা। কারণ, পাহাড়ের রাজস্বের অন্যতম উৎস এই সংরক্ষিত অরণ্য। তবে, জিটিএ-র আওতায় সংরক্ষিত অরণ্য দেওয়া হলে পাহাড়ের সবুজ রক্ষা পাবে কি না, তা নিয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রক সংশয় জানায়। গুরুঙ্গদের যুক্তি, বড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিলের আওতাতেও সংরক্ষিত অরণ্য আছে।
এই দুই বিষয়ের নিষ্পত্তি না হওয়ায় জিটিএ বিলটিও ঝুলে ছিল। মমতার অভিযোগ ছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘ঢিলেমি’র জন্য পাহাড়ে নতুন আঞ্চলিক প্রশাসন গঠন করতে দেরি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কাছেও এ বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দেন, দু’তিন দিনের মধ্যেই বিলটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি ‘সদর্থক বার্তা’ পাঠিয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু একই সঙ্গে ‘কৌশলে’ বিতর্কিত বিষয়গুলি মীমাংসার দায়ও মমতার উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাকি সব বিষয়েই ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্র।
রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ এ দিন জানান, পাহাড়ের কোন কোন এলাকা জিটিএ-র অন্তর্ভুক্ত হবে, সেই কাজ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার পাশাপাশিই চলবে। তাঁর মন্তব্য, “রাষ্ট্রপতির সম্মতি মানেই আইন হয়ে গেল। গেজেট বিজ্ঞপ্তি হলেই জিটিএ-এর নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।” নির্বাচনের দায়িত্বে কারা থাকবে, তার জবাবে সমরবাবু বলেন, “রাজ্য নির্বাচন কমিশনের শুধু পঞ্চায়েত বা পুরসভার নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে। জিটিএ-র ক্ষেত্রে অন্য কোনও এজেন্সিকে দায়িত্ব দিতে হবে।”
বস্তুত, সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিতর্ক এত তাড়াতাড়ি মিটবে না বুঝে ‘মনোনীত জিটিএ’-র পক্ষে সওয়াল শুরু করে দিয়েছে মোর্চা। এ দিন রাষ্ট্রপতির বিল সইয়ের খবর পেয়েই রোশন গিরি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। যদিও ‘মনোনীত জিটিএ’ নিয়ে সরাসরি কিছু বলেলনি মোর্চার সাধারণ সম্পাদক। তাঁর মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। কী ভাবে জিটিএ গঠন হবে, তা পুরোটাই এখন রাজ্যের বিষয়।”
রাজ্য সরকার সব জেনে বুঝেই মনোনীত জিটিএ গঠনের রাস্তায় হাঁটছে বলে মনে করেন গোর্খা লিগের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ খাতি। তাঁর অভিযোগ, “সিপিএম সুবাস ঘিসিংকে নিয়ে যা করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিমল গুরুঙ্গদের নিয়ে তাই করতে চাইছেন। নির্বাচনের বদলে অগণতান্ত্রিক একটি দলকে কৌশলে ক্ষমতায় বসানোর প্রক্রিয়া হচ্ছে। এতে পাহাড়ের মানুষের সমস্যা মিটবে না। দুর্নীতি, অব্যবস্থার হিমালয় তৈরি হবে।” সিপিএম নেতা অশোকবাবু বলেন, “মনোনীত জিটিএ হলে আমরা তীব্র বিরোধিতা করব। কারণ, জিটিএ আইনে মনোনয়নের কোনও বিষয়ই নেই।”
পূর্বতন পার্বত্য পরিষদ বা ডিজিএইচসি-র এলাকা সীমাবদ্ধ ছিল দার্জিলিঙের তিন মহকুমায়। তুলনায় জিটিএ-তে অনেক বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা, বাণিজ্য, কৃষি, পর্যটন, শিশু ও নারী কল্যাণ, পরিবহণ, নগরোন্নয়ন, ক্রীড়ার মতো ৫৯টি দফতর দেওয়া হয়। ৫০ সদস্যের জিটিএ-তে সরকারি প্রতিনিধি থাকবেন ৫ জন। সেখানে পার্বত্য পরিষদের ৪২ জন সদস্যের মধ্যে রাজ্যের প্রতিনিধি ১৪ জন। নির্বাচন হত ২৮টি আসনে। জিটিএ-তে নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪৫।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.