অস্ত্রোপচারে দেরির খেসারত
ছ’হাসপাতালে দু’সপ্তাহ ঘুরে হাত হারালেন দিনমজুর
সানসোল মহকুমা হাসপাতাল থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল, সেখান থেকে এসএসকেএম। তার পরে শম্ভুনাথ পণ্ডিত-এমআর বাঙুর হয়ে আবার এসএসকেএম। তাতেও শেষ নয়। সেখান থেকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল ঘুরে ফের এমআর বাঙুর। ছ’-ছ’টা সরকারি হাসপাতালে (তার তিনটে আবার মেডিক্যাল কলেজও) টানা দু’সপ্তাহের সফর!
তবু চিকিৎসা-ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি বীরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের। দুই হাত বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া সাতাশ বছরের যুবকটির অস্ত্রোপচারের দায়িত্ব কেউ নিতে চায়নি। চোদ্দো দিন দিন ধরে পচন ছড়িয়েছে পোড়া দুই হাতে। দুর্গন্ধ বেরোচ্ছিল। শেষে যখন পচন শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিল, তখন টনক নড়ল স্বাস্থ্য-প্রশাসনের। স্বাস্থ্যভবনের ‘বিশেষ নির্দেশে’ মঙ্গলবার সকালে এম আর বাঙুর হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে ওই দিনমজুরের দু’টো হাতই কেটে বাদ দিতে হল কনুইয়ের নীচ থেকে।
অথচ বীরেন্দ্রবাবুর যথাযথ চিকিৎসা যে কোথাও হচ্ছে না, সে ব্যাপারে তাঁর পরিবার এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের তরফে চার-পাঁচ দিন আগেই স্বাস্থ্যভবনে অভিযোগ জানানো হয়েছিল। তার পরেও কেন এই বিভ্রাট? তা ছাড়া বাঙুরের মতো জেলা হাসপাতালে যে অপারেশন করা গেল, তিন-তিনটে মেডিক্যাল কলেজে তা কেন হল না? এ নিয়ে তদন্ত হচ্ছে কি?
এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী শুধু বলেন, “আমার কাছে মানবাধিকার কমিশনের ফোন এসেছিল। তার পরে আমি ওই রোগীকে এমআর বাঙুরে ভর্তি করে চিকিৎসা করতে বলি। আর কোন কোন হাসপাতাল ওঁর অপারেশন না-করে অন্যত্র রেফার করেছে, তা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।”
হাসপাতালে বীরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। — নিজস্ব চিত্র
বাঙুরের ডাক্তারদের অবশ্য মাথায় ঢুকছে না, বিদ্যুতের তারে দু’হাত গুরুতর ভাবে পুড়ে যাওয়ার পরেও কেন এত দিন বীরেন্দ্রবাবুকে অস্ত্রোপচার না-করে ঘোরানো হল। তাঁরা বলছেন, সময়ে অস্ত্রোপচার হলে হাত বেঁচেও যেতে পারত। অথবা অল্প কিছুটা কেটে বাদ দেওয়া যেত, যাতে ‘প্রস্থেসিস’ যন্ত্রের মদতে তিনি হাতের কাজ কিছুটা চালাতে পারতেন। কিন্তু বাঙুরও তো প্রথমে ওঁকে অন্যত্র রেফার করেছিল?
বাঙুর-কর্তৃপক্ষের দাবি: তাঁদের ওখানে ভাস্কুলার সার্জারি হয় না বলেই রোগীকে প্রথমে তাঁরা এসএসকেএম, পরে ন্যাশনালে পাঠান। দু’জায়গাই তাঁকে ফেরত পাঠায়। অবশেষে স্বাস্থ্যভবনের নির্দেশে এ দিন বাঙুরেই বীরেন্দ্রবাবুর দু’হাত বাদ দেওয়া হয়। বাঙুরের চিকিৎসকদের প্রশ্ন, “বর্ধমান, এসএসকেএম বা ন্যাশনালের মতো মেডিক্যাল কলেজে ভাস্কুলার সার্জন থাকার কথা। সেখানে না-করে বাঙুরের মতো জেলা হাসপাতালকে কেন এই রোগীর অপারেশন করতে বলা হল?”
এ সবের উত্তর রোগীর জানা নেই। এ দিন অস্ত্রোপচারের পরে হাসপাতালের বেডে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে শুয়েছিলেন বীরেন্দ্র। পাশে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন স্ত্রী আশাদেবী ও বৃদ্ধ বাবা নির্মলবাবু। কী করে এমন হল?
বীরেন্দ্র থেমে থেমে জানালেন, আসানসোল নিউটাউন আট নম্বর বস্তিতে তাঁর বাড়ি। গত ২০ ফেব্রুয়ারি, শিবরাত্রির রাতে শৌচাগার থেকে ফেরার সময়ে দেখেন, রাস্তায় একটা তার ছিঁড়ে পড়ে আছে। সরানোর জন্য তারটা দু’হাত দিয়ে ধরতেই ‘শক’ লাগে। তাঁকে ভর্তি করা হয় আসানসোল মহকুমা হাসপাতালে। দু’সপ্তাহের টানাপোড়েনের সেই শুরু। আসানসোল তাঁকে রেফার করে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে কিছু দিন ভর্তিও থাকেন। কিন্তু সার্জনরা শুধু ‘ফ্যাসিওটমি’ করে হাতে জমা তরল (ফ্লুইড) বার করে দায়িত্ব সারেন বলে অভিযোগ। ভাস্কুলার থ্রম্বোসিসের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার না-করে তাঁকে রেফার করে দেওয়া হয় এসএসকেএমে।
কেন অস্ত্রোপচার করল না বর্ধমান মেডিক্যাল?
বর্ধমানের সার্জনদের যুক্তি, “মেডিক্যাল কলেজ হলেও এখানে কার্ডিওভাস্কুুলার বিভাগ নেই। ভাস্কুলার সার্জন বা প্লাস্টিক সার্জন নেই। ওঁকে রেফার না-করে উপায় ছিল না।” তা হলে এসএসকেএম কেন দু’-দু’বার ওই গুরুতর রোগীকে ফেরত দিল?
এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের বক্তব্য, “এখানে মেঝেতেও রোগী উপচে পড়ছে! আর কোথায় ভর্তি নেব? এমন কেস রেফার করার আগে ডাক্তারদের উচিত রেফারেল হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলা। কী রকম অপারেশন দরকার, তা জানানো। দেখতে হবে, তা হয়েছে কি না।”
আর ন্যাশনাল মেডিক্যালের ভূমিকা?
বীরেন্দ্র জানাচ্ছেন, “ওখানকার ডাক্তারবাবুরা সোজা বলে দিলেন, এমন গন্ধওয়ালা রোগী আমরা নিই না! শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না!” ন্যাশনাল-কর্তৃপক্ষ কী বলছেন?
ন্যাশনালের সুপার পার্থ প্রধানের দাবি, “ওটা ইমার্জেন্সি কেস হতেই পারে না। যদি হয়ও, তা হলে বাঙুর কেন রেফার করল? ওদের সার্জন নেই?”
সরকারি হাসপাতালে-হাসপাতালে এই পারস্পরিক দোষারোপের পালার মধ্যে দু’হাত খুইয়ে রুদ্ধবাক হতদরিদ্র দিনমজুর। যিনি এখনও জানেন না, দুই শিশুসন্তানের মুখে অন্ন জোগানোর সংস্থান করবেন কী ভাবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.