পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন বলিয়াছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের উন্নতিসাধনে কৃতসঙ্কল্প, এ রাজ্যে (মন্দ) কিছু ঘটিলে তিনি উদ্বিগ্ন বোধ করেন। রাজ্যপালের কথা বিশ্বাস না করিবার কোনও কারণ নাই। নয় মাসের মুখ্যমন্ত্রিত্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণে সদিচ্ছা এবং উদ্বেগের বহু লক্ষণ নিরবচ্ছিন্ন ভাবেই দেখা গিয়াছে। তিনি নিজে বহু বার বলিয়াছেন, মা মাটি মানুষের ভাল করিতে চাহেন, এবং সত্বর করিতে চাহেন। মুখ্য প্রশাসকের এই দ্রুতগামী আকাঙ্ক্ষা পশ্চিমবঙ্গের উন্নতি সাধনের গুরুত্বপূর্ণ সহায়। যেহেতু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার দল এবং সরকারের সর্বময়ী কর্ত্রী, সুতরাং তাঁহার এই তৎপরতা রাজ্যের অগ্রগতির জরুরি শর্তও বটে কার্যত সমস্ত ক্ষেত্রে প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগ যাঁহার উপর নির্ভরশীল, তিনি যদি রাজ্যের ভালমন্দ সম্পর্কে উদাসীন থাকেন, ‘এ রকম তো কতই হয়’ বলিয়া তাচ্ছিল্য সহকারে হাঁটিয়া চলিয়া যান, তবে তো কিছুই চলিবে না। সুতরাং, রাজ্যপালের কথায় রাজ্যবাসী ভরসা পাইতে পারেন যে, মাথার উপরে মুখমন্ত্রী আছেন, তিনি সতত রাজ্যের মঙ্গল লইয়া ভাবিতেছেন।
যেখানে ভরসা, সেখানেই আশঙ্কা। মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনের কর্ণধার। তিনি প্রশাসনের বিষয়ে সজাগ, সচেতন থাকিবেন, তাহাই প্রত্যাশিত এবং আবশ্যক। কিন্তু প্রশাসনকে তো তাহার নিজস্ব নিয়মে ও শক্তিতে কাজ করিতে হইবে, পদে পদে মুখ্যমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিলে চলিবে কেন? অথচ বহু উপলক্ষে বারংবার দেখা যাইতেছে, যে কাজ প্রশাসনের স্বতঃই করিবার কথা, মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করিলে তবে তাহা করা হইতেছে। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ খিদিরপুরে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে নিগ্রহের দায়ে অভিযুক্ত আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ভ্রাতুষ্পুত্র, তথাপি গ্রেফতার হইয়াছেন, হাজতবাসও করিয়াছেন, এই ঘটনাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরপেক্ষতা ও রাজধর্ম পালনের পরাকাষ্ঠা হিসাবে দেখিলে সেই দর্শনকে হয়তো মিথ্যা বলা চলে না, কিন্তু অবশ্যই অর্ধসত্য বলা চলে। মুখ্যমন্ত্রীর স্বজনকেও আইনের শাসন, অন্তত প্রাথমিক ভাবে, মানিতে হইয়াছে ইহা নিশ্চয়ই তুচ্ছ করিবার বিষয় নহে। কিন্তু ইহাও কম গুরুত্বপূর্ণ নহে যে, তিনি আপন ‘পরিচয়’ জানাইয়া আস্ফালন করিবার পরে প্রথমে তাঁহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছিল, পরে আটক করা হয়। এমন কথা মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, মুখ্যমন্ত্রীর ছাড়পত্র বা নির্দেশ পাইয়া তবেই পুলিশ তাঁহাকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত লইতে পারে। সহজ প্রশ্ন, যাহা করিবার, তাহা কেন প্রশাসন আপনিই করিবে না, এবং তৎক্ষণাৎ করিবে না? কেন মুখ্যমন্ত্রীকে এই বিষয়ে আদৌ হস্তক্ষেপ করিতে হইবে? রাজধর্ম তখনই সার্থক, যখন প্রশাসন স্বভাবত সেই ধর্ম পালনে অভ্যস্ত হয়। সতত সংশয়াকুল, সন্ত্রস্ত প্রশাসনকে প্রতি পদক্ষেপে নেত্রীর মুখ চাহিয়া থাকিতে হইবে, তিনি সেই নাবালক প্রশাসনকে ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ করাইবেন, ইহা রাজধর্মের পরাকাষ্ঠা নহে।
সততা, নিরপেক্ষতা, সদিচ্ছা, এই সকলই রাজধর্মের শর্ত। কিন্তু আর একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হইল সংযম। সংযমের অর্থ নিষ্ক্রিয়তা নয়, সংযমের অর্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নীতি অনুসারে কাজ করিতে দেওয়া, অপ্রয়োজনে সেই কাজে নিজেকে না জড়ানো। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অনেকগুলি ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী আগ বাড়াইয়া এমন অনের মন্তব্য করিয়াছেন, যাহার কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না। আমরি কাণ্ডে ধৃতদের জামিন সম্পর্কে তাঁহার মন্তব্য, পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের অভিযোগ বেমালুম উড়াইয়া দেওয়া, যাদবপুরে সাংবাদিক নিগ্রহকে ‘সাজানো ঘটনা’ আখ্যা দেওয়া প্রত্যেকটিই অবাঞ্ছিত এবং অত্যন্ত আপত্তিকর অসংযমের পরিচায়ক। রাজ্যপাল বলিয়াছেন, মুখ্যমন্ত্রী কখনও কখনও এমন কথা বলেন, যাহার বিকৃত অর্থ নির্মাণ করা যায়। কে তাঁহার কোন কথার কোন বিকৃত অর্থ করিয়াছে, সেই বিতর্ক থাকুক। মূল প্রশ্ন একটিই: মুখ্যমন্ত্রী অনেক বিষয়ে অনেক কথা না বলিলেই তো আর অর্থবিকৃতির কোনও অবকাশ থাকে না। |