আপাত নিরীহ একটি ই-মেল। তাতে অচেনা এক ব্যক্তির ‘বন্ধুত্বের’ আমন্ত্রণ। মেলটি খুলেছিলেন গুজরাতের এক ব্যক্তি। তার পরেই এক দিন দেখলেন, তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁর অজ্ঞাতেই কয়েক লক্ষ টাকার লেনদেন হয়েছে কলকাতার একটি বহুজাতিক ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে। ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, ওই ব্যক্তির কম্পিউটার ‘হ্যাক’ করে ই-ব্যাঙ্কিংয়ের আইডি এবং পাসওয়ার্ড হাতিয়ে এই কাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
তদন্তকারীরা বলছেন, এই ধরনের জালিয়াতি হচ্ছে ‘ট্রোজান’-এর মাধ্যমে। গ্রাহকের অজ্ঞাতে তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দিতে এটাই এখন মূল অস্ত্র জালিয়াতদের।
কী এই ট্রোজান?
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এটি একটি সফট্ওয়্যার। ই-মেল বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের মাধ্যমে ওই ট্রোজান পাঠিয়ে দেওয়া হয় ‘শিকারের’ কম্পিউটারে। এক বার এটি কম্পিউটারে ঢুকে গেলেই কেল্লা ফতে! তার পরে কম্পিউটার ব্যবহারকারীর অজ্ঞাতেই ওই কম্পিউটারের যাবতীয় গোপন তথ্য পাঠাতে থাকে হ্যাকারের কাছে। সেই তথ্য ব্যবহার করেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরানো হয়। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, “কখনও সাধারণ মানুষের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উধাও হয়। কখনও বড় ব্যবসায়ীদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে টাকা সরিয়ে নেওয়া হয় অন্য অ্যাকাউন্টে।” |
এড়িয়ে চলুন |
ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত কাজে |
• অপরিচিতের ই-মেল
• সোশ্যাল নেটওয়ার্কে
অচেনা কারও আমন্ত্রণ
• লটারি সংক্রান্ত
এসএমএসের জবাব দেওয়া
• কাউকে অনলাইন ব্যাঙ্ক
আইডি-পাসওয়ার্ড দেওয়া
• ব্যাঙ্কের আসল সাইট না চিনে ব্যবহার |
• সরাসরি ব্যাঙ্কের শাখায় যান
• কাউকে ভোটার বা প্যান
কার্ডের প্রতিলিপি দেবেন না
• অপরিচিতকে অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে
তথ্য দেবেন না
• ফোন ব্যাঙ্কিংয়ে ব্যক্তিগত তথ্য দেবেন না
• ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে
মনে
হলেই পুলিশকে জানান |
|
শুধুই কি ট্রোজান? গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এর বাইরে রয়েছে এসএমএস বা ফোনের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক-জালিয়াতির চিরাচরিত প্রথাও। এক অফিসার জানান, প্রথমে মোবাইলে একটি এসএমএস আসে। তাতে বলা হয়, ‘আপনি অনলাইন লটারিতে কয়েক কোটি পাউন্ড পেয়েছেন।’ সেই এসএমএস-এর জবাবে একটি ই-মেল পাঠাতে বলা হয়। সেই ই-মেল থেকে বিস্তারিত তথ্য জেনে নেওয়ার পরে ‘বিজয়ী’কে বলা হয়, ‘বিদেশ থেকে এক ব্যক্তি আপনার টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। পুরস্কার নেওয়ার জন্য একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কয়েক লক্ষ টাকা জমা করতে হবে।’ এর পরে বিশ্বাস অর্জনের জন্য লটারি সংস্থার প্রতিনিধির ছবি ও বিমানের টিকিট ই-মেলে পাঠানো হয়। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, সেই বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই টাকা হাতিয়ে নেয় দুষ্কৃতীরা। এই ফাঁদে লক্ষ লক্ষ টাকা খুইয়েছেন এ শহরের অনেকেই।
তদন্তকারীরা আরও জানাচ্ছেন, অনেক সময়ে ফোন-ব্যাঙ্কিংয়ের নাম করেও জালিয়াতি চলছে। এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, জালিয়াতেরা বিভিন্ন ব্যাঙ্কের নাম করে গ্রাহকদের ফোন করে। আর কথার ছলে তাঁদের কাছ থেকে নানা ব্যক্তিগত তথ্য জেনে নেয়। পরে সেই তথ্য কাজে লাগিয়েই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নেয় তাঁরা। পুলিশ সূত্রের খবর, বছরখানেক আগে, একটি বহুজাতিক ব্যাঙ্কের প্রাক্তন কর্মী এই ধরনের জালিয়াতির অভিযোগে ধরা পড়েছিলেন। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ওই ব্যক্তি অফিস ছাড়ার সময়ে বহু গ্রাহকের ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত তথ্য হাতিয়ে নিয়েছিলেন। পরে তা দিয়েই জালিয়াতি শুরু করেন।
তদন্তকারীরা জানান, জালিয়াতির টাকা কখনওই সরাসরি চক্রের পাণ্ডাদের অ্যাকাউন্টে নেওয়া হয় না। পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন শহরে এজেন্ট ছড়িয়ে রাখে পাণ্ডারা। এজেন্টদের মাধ্যমেই টাকা লেনদেন হয়।
পুলিশ সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত যে সব অপরাধীকে এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই বিদেশি নাগরিক। তারা দেশের বিভিন্ন শহরের যুবকদের কমিশনের লোভ দেখিয়ে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলায়। এর পরে কোনও ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তার টাকা ওই যুবকদের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলা হয়। ওই যুবকেরা সেই টাকা তুলে হ্যাকারদের নির্দেশ মতো অন্য একটি অ্যাকাউন্টে জমা করে। বিনিময়ে কমিশন পায়। পুলিশ জানাচ্ছে, এ ভাবেই একের পর এক এজেন্টের হাত বদলে টাকা পৌঁছয় জালিয়াতদের হাতে।
এক পুলিশ অফিসার বলেন, “মুম্বইয়ের মীরা রোড, দিল্লির সফদরজং-সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসে এক দল বিদেশি এই চক্র চালিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং কলকাতাতেও এমন কিছু যুবক ঘাঁটি গাড়ছে বলে খবর। এ ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকদের অনুরোধ করা হচ্ছে, বিদেশিদের ভাড়া দিতে হলে পাসপোর্ট এবং ভিসার তথ্য স্থানীয় থানায় জানিয়ে রাখা উচিত।” |